|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
আজও চলছে ভাবনা এবং প্রতিমাকল্পের মধ্যে সংঘাত |
সম্প্রতি স্টুডিও ২১-এ চলছে আট জন শিল্পীর সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি স্টুডিও ২১-এ চলছে আট জন তরুণ শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে সম্মেলক প্রদর্শনী। এদের মধ্যে মাত্র এক জন ভাস্কর। প্রদর্শনীর শিরোনাম: ‘কনফ্রন্টেশন: কনফ্লিক্ট বিটুইন আইডিয়াজ অ্যান্ড ইমেজেস’।
আইডিয়া ও ইমেজ ভাবনা এবং প্রতিমাকল্প, এই দুইয়ের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই গড়ে ওঠে ছবি বা ভাস্কর্য। ভাবনাকে শিল্পী প্রতিমায় রূপান্তরিত করেন। সেই প্রতিমা মূর্তও হতে পারে, বিমূর্তও হতে পারে। তাদের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি হয়। তারা পরস্পর পরস্পরকে সম্বোধন করে। কিন্তু কখনও কি সংঘাত তৈরি হয় তাদের মধ্যে? সম্বোধন বা পারস্পরিক কথালাপ চিরন্তন শিল্পের ধর্ম। আধুনিকতা পর্যন্তও সেটা সত্য ছিল। কিন্তু আধুনিকতাবাদী ও আধুনিকোত্তর যুগে এই সংলাপের ভিতর একটা সংঘাতও জেগে উঠল। ১৯১২ সাল পিকাসো চিত্রপটে সেঁটে দিলেন তথাকথিত অনান্দনিক বস্তু। ১৯১৭ সাল মার্সাল দ্যুসা একটি মূত্রাধার অর্থাৎ একটি রেডিমেডকে ভাস্কর্য বলে অভিহিত করলেন। ‘আইডিয়া’ ও ‘ইমেজ’-এর মধ্যে সেই যে সংঘাত শুরু হল সেটা আজও চলছে নানা ভাবে। বাস্তবের বিরুদ্ধে প্রগাঢ় প্রতিবাদী চেতনা গড়ে তোলাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। আট জন শিল্পীর মধ্যে এই সংঘাতের কিছু কিছু নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়।
দেবতোষ করের তিনটি ভাস্কর্যে যেমন কাঠের উপর রং ব্যবহার করে তিনি গড়েছেন ‘সিগারেট’ শিরোনামে রচনা। অর্ধেকের বেশি পুড়ে যাওয়া সিগারেটটি ছাই সমেত দাঁড়িয়ে আছে। লোহা ও ফাইবারে তৈরি ‘ব্রাশ’ নামে রচনাটি শূন্যে ঝুলছে। স্প্রিং দিয়ে তৈরি হয়েছে এর আলুলায়িত ‘ব্রিসল’গুলো। ‘কিজ’ রচনায় এক গোছা চাবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার একটিতে সাপলুডো-র প্রতিমা সাঁটা। পপ-আর্টের অনুষঙ্গ এ সব কাজে। সেই সূত্রেই এসেছে ভাবনা ও প্রতীকের সংঘাত।
সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তিনটি বড় আকারের ছবি ক্যানভাসের উপর অয়েলবার দিয়ে আঁকা। বর্ণময় অভিব্যক্তিবাদী ঝংকৃত রূপায়ণে পথের মানুষদের প্রতিমাকল্প এঁকেছেন। খুবই বলিষ্ঠ রচনা। পথের উপর হাঁটু গেড়ে বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে এক জন। ছবির নাম ‘পারফর্মেন্স’। ভিক্ষুক ধরনের এক বৃদ্ধ লোক ওরকমই বসে আছে পথের উপর। শিরোনাম- ‘ওল্ড ম্যান’। বাস্তবকে বিশ্লিষ্ট করে কিমাকারের দিকে নিয়ে গেছেন। ভাবনা ও প্রতিমার সমন্বয়ের ভিতর থেকেই সংঘাত বের করে এনেছেন। |
|
শিল্পী: তিমির ব্রহ্ম |
চন্দনা মুখোপাধ্যায়ের চারটি তেলরঙের ক্যানভাসেও সমধর্মী কল্পরূপাত্মক ঝংকৃত প্রতিমাকল্প। তাঁর ছবিতে যে শ্লেষ সেটা কৌতুকদীপ্ত ভাবে আজকের বাস্তবতাকে নানা ভাবে প্রশ্ন করে। ‘গণেশ উইথ মি সেলিব্রেটিং ক্রিসমাস’ ছবিতে গণপতি চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছেন। প্লেটে সাজানো লাড্ডু। উপরে সবুজ ডানার মেয়েটি উড়ছে। ভাবনার মধ্যে কিছুটা সংঘাতের ঝংকার।
অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে পপ-অনুষঙ্গের কল্পরূপাত্মক প্রতিমা। ‘উই হ্যাভ ফরগটেন টু ক্রাই’ শীর্ষক রচনায় বিস্তীর্ণ সাদা প্রেক্ষাপটে দ্বিমাত্রিক ভাবে সংস্থাপিত একটি ছেলের মুখ। হাল্কা বাদামি ছায়াতপে আঁকা। চোখ ও দাঁতের উপস্থাপনায় সাদার বৈপরীত্য। ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি লাভ’ নামের ছবিটিতে মুখ-খোলা একটি বড় কুকারের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়েছে একটি ঘনকৃষ্ণ মানুষ। বিস্ফারিত এই প্রতিমাকল্পেই সংঘাতের দ্যোতনা আছে।
তিমির ব্রহ্মের তিনটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসেও পপ-আর্টের অনুষঙ্গে বিস্ফারিত প্রতিমাকল্প। ‘ওপেন চেস্ট’ রচনায় জ্যাকেট পরা এক যুবক দৃশ্যমান। বুকের উপর সমকেন্দ্রিক অজস্র বৃত্ত। শুটিং-এর টার্গেটের অনুষঙ্গ তাতে। সেই লক্ষ্যে তির ছুড়ছে কার্টুনসদৃশ একটি শিশু। পরিবৃত হিংসার প্রতীক। অনামা একটি রচনায় বাইনোকুলার চোখে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি শিশু। হাতে লাল রঙের পিস্তল। ‘হনি ম্যান’ শিরোনামটি হনুমান-এর ধ্বনি বহন করে। হনুমানের ভঙ্গিতে এক যুবকের উপস্থাপনা। হাতে গন্ধমাদন সদৃশ যে পাহাড়, তাতে একটি মেয়ের ছবি। শ্লেষাত্মক রচনায় প্রতিমা প্রতীকের অনুষঙ্গবাহী। অপু দাশগুপ্ত জলরঙে ছ’টি ড্রয়িং করেছেন। সমকামী যৌনতা তাঁর কয়েকটি ছবির বিষয়। রাজনীতির শূন্যগর্ভ বক্তৃতার অনুষঙ্গ।
পাপু বর্ধনের মিশ্রমাধ্যমের তিনটি ছোট রচনায় কল্পরূপের বিভিন্ন প্রকাশ। আঙুল এঁকেছেন সাপের মতো জড়ানো। আর একটি ছবিতে মুখের একটি প্রান্ত। মুখে পেরেক সাঁটা। আরও একটু গভীর কাজের প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছ থেকে।
দেবস্মিতা সামন্তর ছ’টি ছোট ছবি কোলাজধর্মী ও আলোকচিত্র ভিত্তিক। শিরোনাম- ‘মাই হিরো’। যেহেতু আলোকচিত্র ব্যবহার করেছেন, তাই প্রতিমাকল্পে স্বাভাবিকতার আবহ আছে। আবার তাঁর যে ‘হিরো’ বা নায়কের সন্ধান সেটা বিমূর্ত ও কল্পরূপাত্মক। এই দুই প্রকাশভঙ্গির সংঘাত রয়েছে তাঁর প্রতিমাকল্পে। |
|