|
|
|
|
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি |
সার্নের কর্মকাণ্ড |
|
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য
এনেই সফল চার ‘স’
কুন্তক চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
|
একের পর এক যন্ত্রাংশ জোড়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এমন এক ‘যন্ত্র’ (বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম সিলিকন ট্র্যকার), যা দিয়ে মাপা যাবে প্রোটন-প্রোটন কণার সংঘর্ষে উৎপন্ন বিভিন্ন কণার পথ এবং তাঁদের উৎস। আর সেই গোটা কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী। সেই যন্ত্র যখন সার্নে সফল মহড়া দিল, অন্যদের মতো শিহরিত হয়েছিলেন তিনি। সুচন্দ্রা দত্ত।
কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউটের আর এক গবেষক সাত্যকি ভট্টাচার্য বলছেন, অত বড় যন্ত্র যখন চলা শুরু করল, বিস্ময় কাটতে চায়নি।
বহু দিন ধরেই সার্নের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন বিজ্ঞানী সুবীর সরকার। কিন্তু তাঁর কাছে সাহা ইনস্টিটিউটের দলের সদস্য হয়ে সার্নে যোগ দেওয়াটা ছিল অন্য রকম আনন্দের। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুবাদেই বহু বছর পরে বিদেশ থেকে নিজের রাজ্যে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি।
অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই বিজ্ঞানীরাই হিগস-বোসন গবেষণায় আজ বিশ্বের দরবারে কলকাতার নাম তুলে ধরেছেন। কী থেকে মিলল এই সাফল্য?
পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা বলছেন, এই দলের সাফল্যের রহস্য ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’। একই কথার প্রতিধ্বনি মিলেছে দলের নেতা সুনন্দবাবুর কথাতেও।
কী ভাবে? |
|
|
|
সুচন্দ্রা দত্ত |
সাত্যকি ভট্টাচার্য |
সুবীর সরকার |
|
‘হাই এনার্জি ফিজিক্স’-এর আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে রয়েছেন সুনন্দবাবু। সেখান থেকেই আনন্দবাজারকে তিনি বললেন, “আমাদের দলের প্রত্যেক সদস্যই এক-একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ফলে প্রত্যেকেই নিজ
নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন।” বিষয়টি আরও সহজ করলেন দলের অপর সদস্য, সুবীর সরকার। এ দিন সাহা ইনস্টিটিউটে বসে সুবীরবাবুর ব্যাখ্যা, কোনও গবেষক দলের অন্যতম গুণ তার সদস্যদের বৈচিত্র। সবাই এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেয়ে আলাদা আলাদা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলে কাজ অনেক তাড়াতাড়ি এবং নিখুঁত হয়।
স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, সুনন্দবাবু ২০১০ সালে গবেষক দলটি গড়ার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। তার আগে দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর) এবং আমেরিকার ফের্মিল্যাবের সঙ্গে। এ ছাড়াও, দু’দশকের বেশি সময় ধরে সার্নের নানা গবেষণায় জড়িয়ে রয়েছেন তিনি।
সার্নের এই গবেষণায় কমপ্যাক্ট মিউয়ন সলিনয়েড (সিএমএস) ডিটেক্টরে ক্যালোরিমিটারের কাজ সমন্বয় করেছেন তিনি। তবে, এর বাইরে সফটঅয়্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে।
জলপাইগুড়ি থেকে জেনিভার সার্ন, এই দূরত্বটা পেরিয়েই আজ বিশ্বের দরবারে ফের কলকাতার বিজ্ঞানচর্চাকে তুলে ধরেছেন সুবীর সরকার। জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজের পদার্থবিদ্যার এই ছাত্র উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করেই পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বইয়ের টিআইএফআর-এ। সেখানে সুনন্দবাবুর অধীনে পিএইচ ডি। একই সঙ্গে সার্নের লার্জ ইলেকট্রন-পজিট্রন কোলাইডার (এলইপি) প্রকল্পে কাজ শুরু। ১৯৯৩ সালে প্রথম বার সার্নে প্রবেশের কথাটি আজও অমলিন। বললেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দিকে দিকে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা ঘুরছেন। কিছুটা ভয়-ই পেয়েছিলাম।” পিএইচ ডি সেরে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট করেন এই বিজ্ঞানী। যুক্ত ছিলেন ফের্মিল্যাবেও। ২০০৬ সালে পিসার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএনএফএন-এ। সেই সময় থেকেই সার্নের সিএমএস গোষ্ঠীর সদস্য।
সুবীরবাবু আদতে পদার্থবিদ্যার ছাত্র হলেও ২০০৫ সাল থেকে কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু করেন। হিগস-বোসন কণার সন্ধানে আহরিত তথ্য সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণের যে কম্পিউটার ব্যবস্থা (গ্রিড কম্পিউটিং) রয়েছে, তার সঙ্গেই যুক্ত তিনি। এ দিন বললেন, “এই গবেষণার কাজে সামাজিক বহু অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বের যে তাবড় তাবড় পদার্থবিদদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তা আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।”
মালদহের সন্তান সুচন্দ্রা দত্ত দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ শেষ করে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন রায়গঞ্জ কলেজে। সেখান থেকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে টিআইএফআর। সুচন্দ্রাদেবী বলেন, “টিআইএফআর-এ পিএইচ ডি শেষ করেই সিলিকন ট্র্যাকারের কাজ শিখতে (সিএমএস ডিটেক্টরের অন্তঃস্থ স্তরটি, যার কাজ প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের পর প্রতিটি কণার পথ চিহ্নিত করা এবং উৎস সন্ধান) পিসায় পাড়ি দিই।” সেখান থেকেই সার্নের গবেষক দলের সদস্য হন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সিএমএস-এর সিলিকন ট্র্যাকার তৈরি এবং সেটি ভূগর্ভে স্থাপন করার পুরো কাজটির সঙ্গেই তিনি জড়িয়ে ছিলেন।
লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি) পরীক্ষায় সিএমএস যন্ত্রে তথ্য সংগ্রহ সম্পর্কিত পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব রয়েছেন এই বিজ্ঞানী। বুধবারের সাফল্যের পর এলএইচসি পরীক্ষার সময়সীমা বাড়িয়েছে সার্ন। তথ্য সংগ্রহের কাজেই অগস্টে ফের জেনিভা পাড়ি দেবেন তিনি।
ছোটবেলায় শুনেছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক ঠাকুর্দার কথা। আর একটু বড় হয়ে পেলেন এক জামাইবাবু এবং শিক্ষককে। এই ত্রয়ীর অনুপ্রেরণাতেই আজ বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে করেন সাহা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাত্যকি ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “ঠাকুর্দা রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের কথায় বিজ্ঞানে আগ্রহ জেগেছিল। আর বিজ্ঞানী-জামাইবাবু প্রদীপ পারিখ এবং শান্তিনিকেতনে স্কুল শিক্ষক অজিত সরকারের অনুপ্রেরণাতে পদার্থবিদ্যায় আকৃষ্ট হই।”
প্রদীপবাবুর কাছ থেকে দু’টি লেন্স পেয়েছিলেন সাত্যকি। শাটল ককের ব্যারেল আর সেই লেন্স দিয়েই প্রথম টেলিস্কোপ। আজও শান্তিনিকেতনের বাড়িতে সেই টেলিস্কোপ রয়েছে।
পদাথর্বিদ্যা পড়তেই প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। অমল রায়চৌধুরী, অমিতাভ রায়চৌধুরীর মতো অধ্যাপকদের সান্নিধ্যে এসে আকৃষ্ট হন ‘হাই এনার্জি ফিজিক্সে’। পরে টিআইএফআর-এ সেই বিষয়েই গবেষণা করেন অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে। টিআইএফআর-এ গবেষণা করতে করতেই সার্নের এলইপি প্রকল্পে কাজ। পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগো থেকে যুক্ত হন এলএইচসি প্রকল্পে। বুধবার সার্নের সাংবাদিক বৈঠকে যে ‘গামা-গামা চ্যানেল’-এর কথা বারবার উঠে এসেছিল, তার তথ্য বিশ্লেষণে যুক্ত ছিলেন তিনি। সাত্যকিবাবু বললেন, “যে কণাগুলিকে আমরা মৌলিক বলে জানিস সেগুলি আদৌ মৌলিক কি না, তা নিয়ে গবেষণা করছি।”
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|