জাতীয় সড়কের ধারে তৈরি হওয়া ভাগাড়ে জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে স্থানীয় নেতা-বাসিন্দাদের একাংশের আক্রমণের মুখে পড়লেন পুরকর্মীরা। তা ঠেকাতে গিয়ে আক্রান্ত হল পুলিশও। ভাঙচুর হয় পুরসভার গাড়ি। শেষ পর্যন্ত লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনে পুলিশ। তার পরে পুলিশ পাহারায় জঞ্জাল ফেলার কাজ হয়। বুধবার দুপুরে জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালাপুরে ঘটনাটি ঘটেছে। ওই ঘটনায় হামলাকারীদের ছোঁড়া ইটে জখম হয়েছেন অন্তত ১২ জন। তাঁদের মধ্যে ২ জন পুলিশকর্মী ও ২ জন পুরকর্মীকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পক্ষান্তরে, গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশের লাঠিতে অন্তত ২০ জন জখম হয়েছেন। তাঁদের নানা বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা করানো হয়েছে। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৬ জনকে আটক করেছে। |
জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “পুরকর্মীরা ওই এলাকায় প্রশাসনের দেওয়া জায়গায় জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। জাতীয় সড়কের ধারে জড়ো হওয়া বাসিন্দাদের সঙ্গে দফায় দফায় পুলিশ এবং প্রশাসনের আধিকারিকদের আলোচনা হয়। হাত-মাইকে বারবার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আর্জিও জানানো হয়। হঠাৎ পুলিশের ওপর ইটবৃষ্টি হতে থাকে। পুরসভার গাড়িও ভাঙচুর হয়। তার পরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস চালানো হয়।” যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেই পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপ প্রধান তথা সিপিএম নেতা কৃষ্ণকান্ত সরকার গোলমালের দায় পুরসভা-প্রশাসনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সাধারণ বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কী ভাবে এলাকায় ভাগাড় তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে? জঞ্জাল ফেলা হলে এলাকায় বাস করা সম্ভব হবে না। আমি নিজে ওই এলাকার বাসিন্দা নই। কিন্তু, পাহাড়পুরের স্বার্থেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।”
এলাকার বাসিন্দা রূপা রায়, ভারতী দেবনাথরা জানান, তাঁরা দূষণ বিরোধী কমিটিও গড়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এদিন পুরসভার কর্মীরা লাঠি, তরোয়াল নিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীদের ওপর আক্রমণ করেছে। কংগ্রেস পরিচালিত জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “সিপিএম নেতারা যে ভাগাড় সমস্যা সমাধানে বাধা দিচ্ছেন তা স্পষ্ট। শিলিগুড়িতেও একই ঘটনা ঘটেছিল বলে শুনেছি। এদিন যে সিপিএমের নেতারা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কেউই ওই এলাকার বাসিন্দা নন। পুরো বিষয়টি নিয়ে নৈরাজ্য তৈরি করতেই সিপিএমের নেতারা বহিরাগতদের নিয়ে গিয়ে সাধারণ বাসিন্দাদের খেপিয়ে তুলে পুলিশ ও পুরকর্মীদের আক্রমণে প্ররোচিত করেছেন।”
এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র। তিনি বলেন, “দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র নিয়েই এলাকায় ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এভাবে যদি বারবার ডাম্পিং গ্রাউন্ড নিয়ে বাধা আসতে থাকে তা হলে জলপাইগুড়ি শহরের পরিবেশই বিষিয়ে যাবে। বৃহত্তর স্বার্থের কথা সকলকে মাথায় রাখতে হবে।”
বস্তুত, ভাগাড় নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে দীর্ঘদিন ধরেই সমস্যা চলছে। যেখানেই জঞ্জাল ফেলার চেষ্টা পুরসভা করেছে, সেখানেই পরিবেশ দূষণের প্রশ্নে বাধা পেয়ে পিছু হটতে হয়েছে পুরকর্মীদের। সমস্যা মেটাতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার পরে শহরের উপকম্ঠে প্রায় জনবসতিহীন ওই এলাকাটি চিহ্নিত হয়। দূষণ নিয়ন্ত্র পর্ষদের সঙ্গে আলোচনার পরে সেখানে ভাগাড় তৈরির ব্যাপারে ছাড়পত্র দেয় প্রশাসন। কিন্তু, স্থানীয় বাসিন্দারা দূষণ বিরোধী কমিটি সগনে আন্দোলনে নামেন। পুরকর্মীরা বাধার মুখে পড়ে জঞ্জাল ফেলতে পারেননি। তাই বুধবার বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে পুরসভার দুটি জঞ্জালের ট্রাক সেখানে যায়। ভাগাড়ে যাওয়ার আগেই তিস্তা সেতু লাগোয়া জাতীয় সড়কের মুখে বাসন্দিরা জড়ো হয়ে পুলিশ ও পুরসভার গাড়ি আটকে দেয়। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে পুলিশের সঙ্গে বাসিন্দাদের আলোচনা চলে। হঠাৎ পুলিশ ও পুরসভার কর্মীদের ওপর ইট বৃষ্টি শুরু হয় বলে অভিযোগ। পুরসভার একটি গাড়িও ভাঙচুর হয়। ইটের আঘাতে পুলিশকর্মীরা জখম হয়। পাল্টা মারমুখী হয় পুরসভার কর্মীরাও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পর পর কাঁদানো গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। মহিলা পুলিশদের লাঠি কেড়ে তাদের ওপরেও কয়েকজন বাসিন্দা চড়াও হয় বলে অভিযোগ। পুলিশও পাল্টা লাঠি চালাতে শুরু করে। পুলিশের লাঠিতে বাসিন্দারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে এদিনই পুলিশি পাহাড়ায় পুরসভার গাড়ি ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ময়লা ফেলে। |
এদিনের ঘটনায় চারজন এলাকাবাসী জখম হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এই ঘটনার পরে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষকর্তাদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা শুরু হয়। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থায়ী ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরির জন্য পুরসভাকে পাহাড়পুরের বালাপাড়ার জমি প্রশাসন বেছে দিয়েছে। আপাতত সেই জমি থেকে সরে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। প্রশাসন সুত্রে দাবি করা হয়েছে, এলাকাটিতে জনবসতি কম থাকাতেই ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের তরফে জানানো হয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার কিংবা পরেও যদি পুরসভা জঞ্জাল ফেলতে যায় তবে প্রতিরোধ করা হবে। |
বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |