বোসনের সঙ্গে শুধু হিগস কেন, বিতর্ক
নজরে নোবেল, কণার নাম নিয়ে তোলপাড়
নামের আমি, নামের তুমি, নাম দিয়ে যায় চেনা!
ব্রহ্মাণ্ডের ভর জোগানদার কণাটিকে একেবারে হাতে-নাতে ধরে ফেলা না-গেলেও তার নাম কী হবে বা হওয়া উচিত, তা নিয়ে শোরগোল চলেছে বিজ্ঞানীমহলে। বিতর্কের কেন্দ্রে আরও বড় একটা বিষয় নোবেল পুরস্কার।
সংবাদমাধ্যমে যার পরিচয় ‘ঈশ্বর কণা’ নামে, তাকে ওই নামে ডাকতে বিজ্ঞানীদের ঘোর আপত্তি। সঙ্গত কারণেই। এই ঈশ্বর তিনি নন, ধার্মিকেরা যাঁর পুজো করেন। আর ধার্মিকদের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের আদায়-কাঁচকলায়। বিজ্ঞানের গূঢ় একটা বস্তু চেনাতে ‘ঈশ্বর’ শব্দটির আমদানি তাই বিজ্ঞানীদের ঘোরতর না-পসন্দ। সমস্যা এখানে কণার বৈজ্ঞানিক নাম ঘিরে। সে নাম হিগস-বোসন। দু’টি শব্দে উপস্থিত দুই বিজ্ঞানী স্কটল্যান্ডের পিটার হিগস এবং ভারতের সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
বোসন-এ কারও আপত্তি নেই, কারণ বোসন হল জাত-পরিচয়, এবং ঈশ্বর কণা সত্যিই ‘বোসন’ জাতের। গোল বেঁধেছে ‘হিগস’ নিয়ে। বোসনের আগে কি থাকবে শুধু স্কটল্যান্ডের ওই বিজ্ঞানীর নাম?
নাহ্, ভুল বলেছিলেন শেক্সপিয়র। দেখা যাচ্ছে, নামে অনেক কিছুই আসে-যায়। বোসনের আগে শুধু হিগস শব্দটিতে অনেকের আপত্তি। ওঁদের যুক্তি, এতে মনে হবে যেন পদার্থের ভরের কারণ আবিষ্কারের মূলে একা পিটার হিগস। যা আদৌ সত্যি নয়। বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নোবেল পুরস্কারের প্রেক্ষাপটে। ঈশ্বর কণা বা ওই জাতের কিছু, যা কিনা পদার্থকে ভর জোগায়, তা পদার্থবিজ্ঞানে এত মূল্যবান যে, শনাক্ত হলেই নোবেল কমিটি নড়েচড়ে বসবে। পুরস্কার অবধারিত। সুতরাং নামের মধ্যে শুধু হিগসের উপস্থিতি অবশ্যই চিন্তার কারণ! হিগস-বোসন মানে যদি শুধু হিগসেরই কৃতিত্ব বোঝায়, তা হলে তো নোবেল কমিটি পুরস্কার দেবেন শুধু তাঁকেই!
অথচ ঘটনা হল, পদার্থের ভরের ব্যাখ্যাদাতা হিগস একা নন। ১৯৬০-এর গোড়ায় পদার্থের ভর ব্যাখ্যার পিছনে বহু বিজ্ঞানী দৌড়েছিলেন। সকলের নাম করলে ডজন গড়িয়ে যাবে। এঁদের অনেকেই সরাসরি কণা সংক্রান্ত গবেষক নন। তাঁরা কাজ করছিলেন ‘সলিড স্টেট ফিজিক্স’ বা বহু কণার একত্রিত চরিত্র নিয়ে। যেমন, ফিলিপ অ্যান্ডারসন। তাঁর কাজে কিছুটা সূত্র পেয়েছিলেন কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা। তেমনই ‘ক্লু’ মিলেছিল আরও দু’জনের গবেষণায় ইয়াচিরো নাম্বু ও জেফ্রি গোল্ডস্টোন।
এল ১৯৬৪। মহা গুরুত্বপূর্ণ বছর। একই বছরে অনেকগুলো গবেষণাপত্র। ভরের রহস্য ব্যাখ্যা করতে। সর্বাগ্রে রবার্ট গাউট ও ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্ট। দু’জনেই বেলজিয়ামের। ওঁদের পরে পেপার ছাপেন পিটার হিগস। তার পরে একই বিষয়ে পেপার লেখেন এক সঙ্গে তিন জন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টমাস কিবল্ এবং তাঁর দুই মার্কিন সহযোগী জেরাল্ড গুরালনিক এবং কার্ল হাগেন। অর্থাৎ পদার্থের ভর ব্যাখ্যাকারী মূল বিজ্ঞানীর সংখ্যা ছ’জন।
তা হলে বাকি পাঁচকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর কণার বৈজ্ঞানিক নামে কেন শুধু হিগস ঠাঁই পাবেন? সকলে জানেন, ছ’জনের মধ্যে শুধু হিগস-ই প্রথম বলেছিলেন বিশেষ কোনও কণার কথা, যা পদার্থকে ভর জোগাবে। বাকি পাঁচ জন কণার কথা বলেননি। কিন্তু কণার অস্তিত্বের অনুমানই তো সবচেয়ে বড় কথা নয়! ভর সৃষ্টির কৌশল ব্যাখ্যা করাও বিরাট কাজ। যা করেছিলেন ওই পাঁচ জন।
মজার ব্যাপার, স্বয়ং পিটার হিগস মনে করেন, মহা গুরুত্বপূর্ণ কণাটিকে শুধু তাঁর নামে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। যদিও তাঁরই এক ছাত্র গবেষণাপত্র লেখার সময়ে প্রথম ‘হিগস-বোসন’ নামটা ব্যবহার করেছিলেন। হিগসও মানেন, কণাটির নামের সঙ্গে ছ’জন বিজ্ঞানীরই উপাধি যুক্ত থাকা উচিত। কিন্তু তা হলে যে একটা কণা বোঝাতে প্রায় একটা বাক্য লিখতে হবে!
ইতিমধ্যে বহু বছর গড়িয়ে গিয়েছে। এত দিন পরে বিশেষ কণাটিকে নতুন নামে চিহ্নিত করা উচিত কি না, সে প্রশ্নে চলেছে বিতর্ক। তাতে যোগ দিয়েছে বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার।’ তার এক সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এত দিন পরে নামবদল ভুল কাজ হবে। কেন?
নেচারের ব্যাখ্যা: ব্র্যান্ডিং (পণ্যের নামকরণ) হল বিপণনের মস্ত বড় দিক। ঈশ্বর কণা ‘ব্র্যান্ডেড’ হয়ে গিয়েছে ‘হিগস-বোসন’ নামে। এখন তা পাল্টানো ঠিক হবে না। কিন্তু কৃতিত্বের দাবি?
নেচারের মতে, বিজ্ঞানে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। যেমন, ব্রহ্মাণ্ড যে প্রসারণশীল, তা প্রথম বলেছিলেন বেলজিয়ামের পাদ্রি জর্জ লেমাইত্রে। অথচ পরে ওই তত্ত্বের আবিষ্কর্তা হিসেবে চিহ্নিত হন আমেরিকার এডুইন হাবল্। আবার রসায়নে ‘অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা’ হিসেবে যা পরিচিত, তা প্রথম গণনা করেছিলেন জোহান জোশেফ লকস্মিট।
বলা বাহুল্য, বহু বিজ্ঞানী এ সব যুক্তি মানেন না। নানা পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে মতামত প্রকাশিত হয়েই চলেছে। ব্লগের তো অন্ত নেই। এবং এতে মোটেই অবাক নন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জন এলিস। তাঁর মন্তব্য, “যা-ই বলা হোক, প্রশ্নটা এখানে নোবেল প্রাইজের।” উল্লেখ্য, পদার্থের ভর ব্যাখ্যার কৃতিত্ব যে শুধু হিগসের প্রাপ্য নয়, ২০১০-এ তা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত পুরস্কার ‘সাকুরাই প্রাইজ’ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ছ’জনকে। তার পরে গত বছর প্রয়াত হয়েছেন রবার্ট ব্রাউট। সুতরাং নোবেলের দাবিদার আপাতত পাঁচ।
কিন্তু নোবেল যে কখনও এক সঙ্গে তিনের বেশি গবেষককে দেওয়া হয় না!
হিগসের বয়স ৮৩। বাকি চার জন অত বয়স্ক নন। আর নোবেল যে হেতু প্রয়াত বিজ্ঞানীকে দেওয়া হয় না, সে হেতু নোবেল কমিটি নিশ্চয়ই পুরস্কার ঘোষণা করতে বসে হিগসের নাম মাথায় রাখবেন। তবে প্রশ্ন থাকছে, তিন জন খেতাব পেলে হিগস ছাড়া অন্য দু’জন হবেন কে কে? পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে এলিস বলছেন, “ভাগ্যিস আমি নোবেল কমিটিতে নেই!”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.