বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
সার্নের মুকুটে এই শহরেরও পালক
ব্রহ্মাণ্ডের অসীম রহস্যময় ঈশ্বর কণা বা হিগস-বোসনের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণার সঙ্গে বুধবার থেকে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে গেল কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং তার পাঁচ গবেষকের নাম।
ওই কণার সঙ্গে বোসন কথাটি থাকায় এর আগে থেকেই অবশ্য বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম জড়িয়ে ছিল (কারণ, ঈশ্বর কণাটা যে বিশেষ জাতের, তার কথা প্রথম বলেছিলেন তিনি)। আর এই দু’য়ের সম্মিলনে স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত কলকাতার গবেষকেরা।
বুধবার সাহা ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা মিলনকুমার সান্যাল বলেন, “সার্নের সাফল্যে আমি অত্যন্ত খুশি। আনন্দ আরও বাড়িয়েছে যুগান্তকারী এই গবেষণায় আমার প্রতিষ্ঠান এবং পাঁচ সহকর্মীর যোগদান।” তিনি জানিয়েছেন, বছর দুয়েক আগে সার্নের এই গবেষণায় যোগ দান করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তৈরি করা হয় কমপ্যাক্ট মিউয়ন সলিনয়েড (সিএমএস) গবেষণার বিশেষ দল। যার সদস্য ছিলেন অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাত্যকি ভট্টাচার্য, সুবীর সরকার, সুচন্দ্রা দত্ত এবং মনোজ শরণ-রা।
এই গবেষণায় কী ভাবে জড়িয়েছিলেন এই বিজ্ঞানীরা?
সার্নে তখন চলছে সাংবাদিক বৈঠক। কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউটে তারই সরাসরি সম্প্রচার। ছবি: রাজীব বসু
দলের সদস্যদের প্রত্যেকেই এক-এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কেউ গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণের দায়িত্বে ছিলেন, কেউ জড়িয়ে ছিলেন কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণে। আবার কেউ কেউ যুক্ত ছিলেন সিএমএস-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরিতেও। আর গোটা দলের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন জেনিভায় ছিলেন তিনি।
গবেষকেরা বলছেন, সার্নের গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ‘গ্রিড কম্পিউটিং’। অর্থাৎ, গবেষণার তথ্য বিশ্বের হাজারটিরও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারে জমা রাখা এবং প্রয়োজন মতো সেগুলি যাতে গবেষকেরা ব্যবহার করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা। এর ফলে গ্রিডের অন্তভুর্ক্ত যে কোনও প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা অন্য প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবেন। এবং তা হবে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই! ফের্মিল্যাব-এর প্রাক্তন গবেষক বিজ্ঞানী সুবীর সরকার বছর খানেক আগে সাহা ইনস্টিটিউটে যোগ দিয়েছিলেন। এই বাঙালি-ই জড়িয়ে ছিলেন সার্নের ‘গ্রিড কম্পিউটিং’-এর সঙ্গে। সুবীরবাবু বলছেন, “যে পরিমাণ তথ্য সার্নের গবেষণা থেকে উৎপন্ন হয়, তা কোনও একটি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারে রাখা দুঃসাধ্য।”
সার্নের এই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহী গবেষকেরাও। সাহা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘গ্রিড কম্পিউটিং’-ই হতে চলেছে আগামী দিনে ইন্টারনেটের অন্যতম বিকল্প।
সুচন্দ্রা দত্তের কাজ সিলিকন ট্র্যাকার নিয়ে। কোলাইডারের ভিতরে যে সিএমএস রয়েছে, তার গায়ে যে স্তর থাকে, সেটিই সিলিকন ট্র্যাকার বলে। এটির কাজ প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের পর প্রতিটি কণার পথ চিহ্নিত করা এবং তাঁদের উৎস সন্ধান। দেড় দশক আগে থেকেই এই ট্র্যাকার তৈরির সঙ্গে যুক্ত সুচন্দ্রাদেবী। সাহা ইনস্টিটিউটের এক প্রবীণ গবেষক বলেন, “উনি দীর্ঘ দিন ধরেই এই সিলিকন ট্র্যাকার নিয়ে কাজ করছেন। এই বিষয়ে সুচন্দ্রাদেবীর দক্ষতা প্রশ্নাতীত।’’
সাংবাদিক বৈঠকে সাহা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। বাঁ দিক থেকে সাত্যকি ভট্টাচার্য, সুবীর সরকার,
মনোজ শরণ, অধিকর্তা মিলনকুমার সান্যাল এবং সুচন্দ্রা দত্ত। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র
বর্তমানে ওই ট্র্যাকার ঠিক মতো কাজ করছে কি না, তা-ও দেখার দায়িত্ব ছিল সুচন্দ্রাদেবীর উপরে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগো-র প্রাক্তন গবেষক, সাত্যকি ভট্টাচার্যের কাজ ছিল তথ্য বিশ্লেষণ। মিলনবাবু জানিয়েছেন, “এ দিন সার্নের সেমিনারে যে ‘গামা-গামা চ্যানেলে’র কথা বার বার উঠে এসেছে, সেটির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন সাত্যকিবাবু। মনোজ শরণ যুক্ত ছিলেন সিএমএস-এর হ্যাড্রোনিক ক্যালোরিমিটারের উপর নজরদারি এবং তথ্য বিশ্লেষণের সঙ্গে।
এ দিন বেলা বারোটা থেকে সাহা ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়ামে জেনিভায় সানের্র বিশেষ সেমিনার দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই সেমিনার দেখতে এ দিন শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরাই নন, হাজির হয়েছিলেন বিভিন্ন গবেষক এবং পড়ুয়ারা। সেই সেমিনারে সার্নের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে দুই প্রোটন কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে নতুন একটি কণার সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা। সেই কণাটির চরিত্রের সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে হিগস-বোসন বা ‘ঈশ্বর কণা’-র। সেই খবরই আনন্দ ছড়াল সাহা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মধ্যে।
গবেষকেরা বলছেন, পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় এ দিন এক মাইলফলক হয়ে রইল। কারণ, এই কণাটির অস্তিত্ব না পেলে পদার্থবিদ্যার একটি বড় অংশ কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়ত। তবে, এ দিনের পরও কিছুটা ‘সাবধানে’ পা ফেলতে চাইছেন কলকাতার বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, কণাটির সঙ্গে হিগস-বোসনের মিল যথেষ্ট। কিন্তু সেটি যে হিগস-বোসন-ই, তা বলার সময় আসেনি। সুবীরবাবুর কথায়, “এখনও এই তথ্য কিছু সংখ্যাতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে। হিগস-বোসন বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেলে আরও গবেষণা এবং তথ্য আহরণ প্রয়োজন।” একই কথা বলছেন পদার্থবিজ্ঞানী অমিতাভ রায়চৌধুরীও। তিনি বলছেন, “এই গবেষণা অনেকটা ভিড়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট চেহারার লোককে খোঁজার মতো। খুঁজে পেলেও সেই লোকটি আসল কি না, তা প্রথমেই বলা যাবে না।” এই তাত্ত্বিক কচকচির মধ্যেও আলাদা আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন সাহা ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা। বছর দুয়েক আগে দেশ-বিদেশ থেকে পাঁচ গবেষককে ধরে এনে সিএমএস গবেষণার দল তৈরি করেছিলেন। এ দিন সাংবাদিক বৈঠকের শেষে হাসতে হাসতে বললেন, “হিগস-বোসন কণা পাওয়া গিয়েছে কি না, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত হতে পারছি না। কিন্তু বছর দুয়েক আগের সেই দল তৈরির সিদ্ধান্তটা নির্ভুল ছিল।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.