স্বপ্নের টিম!
স্বপ্ন ছোঁয়ার রাত!
স্বপ্নের ফাইনাল!
সারা জীবনের সংগ্রহশালায় থেকে যাওয়ার মতো একটা ফাইনাল দেখলাম রবিবার। আমি নিশ্চিত আজ থেকে দশ বছর পরেও ইউরো ২০১২ ফাইনালটা যদি ফুটবলপ্রেমীরা দেখেন, তা হলে নির্ঘাত বলে উঠবেন, “ওফ্! কী অসাধারণ ফুটবলই না সে দিন উপহার দিয়েছিল স্পেন!”
যে কোনও স্পোর্টেই এ রকম এক-একটা দিন যায়। যে দিন একটা টিম যা যা করতে চায় জাদুর মতো সব সে রকম ভাবে হতে থাকে। প্রতিপক্ষের কিছু করার থাকে না। আমার মনে হয় ইউরো ফাইনালটা সে রকম একটা দিন ছিল। ইতালির কোনও ট্যাকটিক্যাল ভুল তাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। যত ম্যাচটা নিয়ে ভাবছি, ৪-০ স্কোরলাইনের একটাই ব্যাখ্যা পাচ্ছি স্পেন এই দিনটায় অপ্রতিরোধ্য ছিল। সামনে যে টিমই পড়ত, উড়ে যেত। ইতালির দুর্ভাগ্য, স্পেন তাদের সেরা খেলাটা ফাইনালের জন্যই তুলে রেখেছিল।
আসলে সেমিফাইনাল দু’টো এত অন্য রকম হয়েছিল যে, কেউ এতটা একপেশে ফাইনাল আশা করেনি। এক দিকে ইতালি ফেভারিট জার্মানিকে হারিয়ে দিল। অন্য দিকে, পর্তুগালের বিরুদ্ধে স্পেন জিতল টাইব্রেকারে। এমনকী একস্ট্রা টাইমেও গোল করতে পারেনি। আমার মনে হয়, সেমিফাইনাল ম্যাচটা স্পেনের কাছে অনেক বেশি টেনশনের ছিল। রোনাল্ডোদের বাঁধাটা পেরিয়ে যেতেই ওদের মেজাজটা অনেক ফুরফুরে হয়ে গেল। যার জন্য ফাইনালে অনেক চনমনে স্পেনকে পাওয়া গেল। |
আমি আর একটা ট্রেন্ডের কথা বলতে চাই। ক্লাব ফুটবলের নিউক্লিয়াসকে জাতীয় দলে খেলিয়ে বাজি জেতার ট্রেন্ড। লক্ষ করে দেখুন, এ বারের ইউরোতে সফল টিমগুলো এই ফর্মুলাই অনুসরণ করেছে। স্পেনের এই টিমটার সাত জন বার্সেলোনায় খেলে। একসঙ্গে সারা বছর খেলার জন্য আপনা-আপনি একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছে ওদের মধ্যে। নতুন করে ইউরোতে এসে কম্বিনেশন গড়ে তোলার ঝক্কি নিতে হয়নি। তেমনই আর এক ফাইনালিস্ট ইতালির ছ’জন খেলে জুভেন্তাসে। জার্মানির আট জন খেলে বায়ার্ন মিউনিখে। এরা প্রত্যেকেই ইউরোতে ভাল খেলেছে।
স্পেনের সঙ্গে বাকিদের তফাত হয়ে যাচ্ছে ফুটবলারদের গুণগত মানে। দেল বস্কির টিমে অন্তত সাত থেকে আট জন বিশ্বমানের ফুটবলার রয়েছে। যে কোনও ভাল দলে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে প্রত্যেকে। ওদের টিমে রোনাল্ডো বা মেসির মতো কোনও মহাতারকা হয়তো নেই। কিন্তু ইনিয়েস্তা, ফাব্রেগাস, জাভি, জাবি আলন্সো, দাভিদ সিলভা, তোরেস, রামোস, কাসিয়াস টিমলিস্ট পড়তে পড়তেই মনে হবে এটা বিশ্বসেরা টিম। তা সে জনপ্রিয়তায় ওরা যতই রোনাল্ডো বা মেসির চেয়ে পিছিয়ে থাকুক।
ইনিয়েস্তাদের স্পেন কি সর্বকালের সেরা ফুটবল দলগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিতে পেরেছে? নিঃসংশয়ে বলার সময় এসেছে যে, অবশ্যই পেরেছে। ’৭৪-এ রেনাস মিশেলস ও ক্রুয়েফের হল্যান্ড টোটাল ফুটবল দিয়ে সারা বিশ্বের মন জয় করে নিয়েছিল। এত জনপ্রিয় টিম হয়েও কিন্তু ওরা বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। রানার্স হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ’৫৪-র পুসকাসের হাঙ্গেরি আছে। কিন্তু তারাও বিশ্বকাপ জেতেনি। অথবা ’৬৬-র ইংল্যান্ড। গর্ডন ব্যাঙ্কস, ববি মুর, ববি চার্লটনদের সেই বিশ্বজয়ী টিম। ’৭০-এর ব্রাজিল। ফুটবল-রত্নে ভর্তি ছিল সেই টিম। পেলে, জেইরজিনহো, টোস্টাও, রিভেলিনহো। ক্লাব ফুটবলে তেমনই সর্বকালের সেরাদের মধ্যে আছে ’৮৯-এর এসি মিলান। যার প্রধান আকর্ষণ ছিল বিখ্যাত ত্রিভুজ। খুলিট-রাইকার্ড-বাস্তেন। সঙ্গে বারেসি, মালদিনি। ইউরোপিয়ান কাপ, সুপার কাপ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ সবই জিতে নিয়েছিল এই টিম। ডি স্তেফানো, পুসকাসদের ’৬০-এর রিয়াল মাদ্রিদকেও তো ভোলা যাবে না। যারা ইউরোপিয়ান কাপ এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছিল।
কিন্তু স্পেনের মতো চার-পাঁচ বছর ধরে টানা ফুটবল বিশ্বকে একচ্ছত্র ভাবে আর কেউ শাসন করতে পারেনি। আমি বিভিন্ন যুগের টিমের মধ্যে তুলনায় বিশ্বাসী নই। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, দলগত দক্ষতায় এত ঝকমক করতে কোনও টিমকে দেখিনি। এত ধারাবাহিকতা আগে কারও মধ্যে দেখিনি। হাঙ্গেরির পুসকাস ছিল। হল্যান্ডের ছিল ক্রুয়েফ। এসি মিলানের ছিল খুলিট-রাইকার্ড-বাস্তেন। কিন্তু একসঙ্গে সাত-আট জন অসাধারণ ফুটবলারকে নিয়ে কোনও টিমকে রাজ করতে অন্তত আমাদের জমানায় দেখিনি। দু’টো ইউরো আর একটা বিশ্বকাপ স্পেনের সেই কর্তৃত্বের ছাপ বহন করছে।
দেল বস্কিকেও এর জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে। কত রকম সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে ওকে। অসহ্য পাসিং ফুটবল খেলছে স্পেন। কেন কোনও স্ট্রাইকার খেলাচ্ছে না? নিজের কোচিং অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই সব মুহূর্তগুলো এক জন কোচের কাছে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং। যখন বাইরে থেকে প্রবল চাপ তৈরি হচ্ছে তার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা লিখছে। প্রাক্তন ফুটবলাররা মন্তব্য করছে। আর কোচ যাবতীয় ঝড়-ঝাপ্টা সামলে নিজের বিশ্বাসে অনড় থাকছে। দেল বস্কি কিন্তু সেটা করে দেখিয়েছে। তোরেসের মতো তারকা স্ট্রাইকারকে বসিয়ে রেখেছে। শেষ পনেরো-কুড়ি মিনিটের জন্য নামিয়েছে। কোনও কোনও ম্যাচে নামায়ইনি। তোরেস কম সময়ের জন্য নেমে সফল হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে দেল বস্কির স্ট্র্যাটেজি কত অব্যর্থ ছিল!
স্পেনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভ্যান্টেজ হচ্ছে, মোটামুটি চোদ্দো-পনেরো জনের একটা দলকে ওরা পাঁচ-ছয় বছর ধরে রেখে দিতে পেরেছে। খুব একটা কেউ বাইরে যাচ্ছে না, নতুন কেউ ঢুকছেও না। এর সঙ্গে যোগ করুন, সারা বছর স্প্যানিশ লিগে একসঙ্গে খেলে যাওয়ার সুবিধে। তা-ও দাভিদ ভিয়া আর পুওল চোটের জন্য ইউরোয় খেলতে পারেনি। ওরা এসে গেলে আরও অপ্রতিরোধ্য দেখাবে স্পেনকে।
টিমটার গড় বয়সও খুব বেশি নয়। যার জন্য ২০১৪-য় ব্রাজিল বিশ্বকাপেও স্পেনের বিজয়রথ চালু থাকতেই পারে। বিরাট কোনও অঘটন না ঘটলে এই স্কোয়াডের পঁচানব্বই শতাংশ পরের বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকবে। দু’বছর পর রিওতেও তাই স্প্যানিশ গিটার বাজতে থাকলে অবাক হব না।
|
ফাইনালের মার্কশিট |
স্পেন |
ইতালি |
|
• কাসিয়াস ৮
• আলবা ৮
• রামোস ৮
• পিকে ৮
• আর্বেলোয়া ৮
• আলন্সো ৮
• বুস্কেতস ৮
• জাভি ৮
• ইনিয়েস্তা ৯
• সিলভা ৮
• ফাব্রেগাস ৮ |
|
• বুফোঁ ৮
• চেলিনি ৩
• বোনুচ্চি ৭
• বার্জাগ্লি ৭
• আবাতে ৬
• পির্লো ৭
• দে রোসি ৭
• মন্তোলিভো ৭
• মার্চিসিও ৬
• কাসানো ৭
• বালোতেলি ৬ |
মোট |
|
৮৯ |
|
৭১ |
|
* পরীক্ষক আর্মান্দো কোলাসো |
|