নাম আছে। কিন্তু সেই নামে কোনও কর্মী নেই। অথচ সেই অস্তিত্বহীন কর্মীরই বেতন বাবদ নিয়মিত টাকা তোলা হচ্ছে!
অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত এমন ‘ভুয়ো’ কর্মীদের বেতন খাতে কলকাতা পুরসভার ভাঁড়ার থেকে এ ভাবে লাখ লাখ টাকা ‘হাতিয়ে’ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ দিন ধরে কয়েকটি ‘এজেন্সি’কেই দরপত্র ছাড়া যে ভাবে ঠিকা-কর্মী জোগানোর বরাত দেওয়া হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে তার ‘বৈধতা’ নিয়েও। ন্যায্য প্রাপ্য থেকে কর্মীদের বঞ্চিত করার অভিযোগও রয়েছে একাধিক সংস্থার বিরুদ্ধে।
এমনিতেই অর্থাভাবে পুর-এলাকায় উন্নয়নের গতি শ্লথ। তার উপরে এই ঘটনায় পুরসভার অর্থ দফতর রীতিমতো বিব্রত। এক অফিসারের কথায়, “বাম বোর্ডের আমলে এর শুরু। তৃণমূলের আমলে সেই ট্র্যাডিশনই চলছে।” তবে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগপত্র পৌঁছানোয় পুর-প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে কর্মীদের মাস-মাইনের তালিকা (স্যালারি শিট) তলব করা হয়। এবং সেই তালিকা থেকেই পরিষ্কার, এমন বহু লোকের নামে বেতনের টাকা নেওয়া হয়েছে, যাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। পুর-প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।”
কলকাতা পুরসভায় সরাসরি নিয়োগ অনেক দিন যাবৎ কার্যত বন্ধ। তাই নিরাপত্তারক্ষী, সাফাইকর্মী ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রায় তিন হাজার লোক নেওয়া হয়েছে এজেন্সি মারফত। এবং এজেন্সির দেওয়া হিসেবের ভিত্তিতেই কর্মীদের বেতনের টাকা, নিরাপত্তারক্ষী ও সাফাইকর্মীদের পোশাকের খরচ জুুগিয়ে এসেছে পুরসভা। উপরন্তু কর্মীপিছু ১০% হারে কমিশন পাচ্ছে এজেন্সিগুলো। পুর-সচিবালয়ের হিসেবে, এই মুহূর্তে ঠিকা-ভিত্তিক অস্থায়ী কর্মীর পিছনে পুর-ব্যয় মাসে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। অর্থাৎ এজেন্সির কমিশনই মাসে ৩৫ লক্ষ। “কিন্তু নজরদারির অভাব ও পুর-কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার সুযোগে কিছু সংস্থা পুকুর চুরি করছে।” মন্তব্য এক আধিকারিকের। কী রকম?
এক অর্থ-অফিসার জানাচ্ছেন, সম্প্রতি একটি এজেন্সি’র চাহিদা অনুযায়ী গঙ্গাপাড়ের নতুন রাস্তার জন্য ৫০ জন নিরাপত্তারক্ষী ও সাফাইকর্মীর পদ তড়িঘড়ি মঞ্জুর করেছে পুরসভা, যাচাই না-করেই। যদিও অর্থ-কর্তাদের অনেকের মতে, ওই মাত্র দু’কিলোমিটারের জন্য অত জনের কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিছু ক্ষেত্রে এক জনকে একই শিফ্টে দু’জায়গায় কাজ করিয়ে দুই কর্মীর নামে টাকা তোলা হয়েছে। আবার কিছু বিল পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, এক জনই অনেকের নামে সই করে টাকা তুলেছেন।
|
এমনকী, কোনও নাম না-দিয়ে রেভিনিউ স্ট্যাম্পে স্রেফ ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়েও বেতন তোলার নজির রয়েছে। সেই ‘নামহীন’ কর্মীরা কারা, সংশ্লিষ্ট এজেন্সি তা জানাতে পারেনি। কর্মীর ‘প্রাপ্যে বঞ্চনা’র দৃষ্টান্তও প্রচুর। যেমন, এক রক্ষীকে পর পর দু’টো শিফ্টে কাজ করানো হলে শ্রম-বিধি মোতাবেক তাঁর তিন শিফ্টের (১+২) বেতন পাওনা হয়। পুরসভা থেকে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি সেই টাকাই নিয়েছে, কিন্তু কর্মীকে দিয়েছে দু’শিফ্টের টাকা। কর্মীরা প্রতিবাদ করেন না?
পুরভবনের এক রক্ষীর জবাব, “জানি, ওরা ঠকাচ্ছে। কাজ হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে পারি না।” পিএফ-ইএসআইয়ের টাকা ঠিকঠাক জমা পড়ছে কি না, তা নিয়েও ওঁরা সংশয়ে। “এজেন্সি আমাদের কোনও কাগজপত্র দেয় না।” বলছেন তিনি।
তদন্তলব্ধ যাবতীয় তথ্য লিখিত ভাবে পুর-কমিশনারকে জানানো হয়েছে বলে অর্থ-সূত্রের খবর। এ প্রশ্নও উঠেছে, বিনা টেন্ডারে এত দিন ধরে গোটা সাতেক এজেন্সিকেই কেন বরাত দেওয়া হল? পুর-অর্থ সূত্রের দাবি: ২০১০-এর নভেম্বরে শুধু বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে লোক সরবরাহের ভার দেওয়া হয়েছিল তিনটি এজেন্সিকে। অর্থ দফতর আপত্তি তুললেও ধোপে টেকেনি।
‘নিয়মভাঙা’ সুযোগ পাচ্ছে যারা, তাদের কী বক্তব্য?
নিজেদের মুনাফার ‘তাগিদের’ পাশাপাশি পুরসভার দিকেও আঙুল তুলছে কিছু এজেন্সি। তাদের দাবি, ‘স্বার্থসন্ধানী’ কিছু পুর-কর্তার চাহিদা মেটানোর সুযোগই তারা নিয়েছে। এক সংস্থার মালিকের কথায়, “কিছু কাউন্সিলর ও পুর-পদাধিকারী চান, তাঁদের পছন্দের লোকজন কাজ পাক। তাদের কাজ দিই বলে আমরা বরাত পেয়ে যাই।”
পুর-ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের এক অফিসারও বলেন, “পার্কে পার্কে রক্ষী রাখা হচ্ছে, যে কাজটা মালিদের দিয়েই চালানো যেত। তবু স্থানীয় কাউন্সিলরেরা পছন্দের লোক ঢোকানোয় অপ্রয়োজনীয় রক্ষীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।” পুর-কর্তৃপক্ষের নজরে কেন পড়ছে না?
এক পুর-কর্তার ব্যাখ্যা, “১৫টা বরোর এতগুলো বাজারে-পাম্প হাউসে-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে-পার্কে কে কোথায় কাজ করছে, তা দেখার মতো লোক আমাদের নেই। এজেন্সিগুলো এর ফায়দা তুলছে।” পুর-সূত্রের খবর: চলতি বছরের গোড়ায় পুর-কমিশনার ‘নিয়ম মেনে’ এজেন্সি নিয়োগে জোর দিয়েছিলেন। মেয়র পরিষদে এ নিয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু ‘বিশেষ’ কারণে তা কার্যকর হয়ে ওঠেনি। |