অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বদলে ওষুধ এসেছিল কাগজের মোড়কে বন্দি হয়ে। গুরুতর অনিয়মটি ‘নজরে’ আসতে সরকার তা নিষিদ্ধ করল বটে, কিন্তু তত দিনে দেড় মাস পার। বিভিন্ন জেলার সরকারি হাসপাতাল থেকে বহু রোগীকে সে সব ট্যাবলেট বিলিও করা হয়ে গিয়েছে, যেগুলোর গুণমান সম্পর্কে কোনও নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না!
স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ মোতাবেক, প্রতিটি ট্যাবলেটের মোড়ক হতে হবে অ্যালুমিনিয়ামের। নচেৎ বাতাস ও জলীয় বাষ্প ঢুকে ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের জন্য ৬০ লক্ষ প্যারাসিটামল এবং ১৫ লক্ষ যন্ত্রণানাশক ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছিল স্রেফ কাগজের মোড়কে। এবং কোনও পরীক্ষা ছাড়াই সেগুলো রোগীদের দেওয়া হয়েছে দেড় মাস ধরে। তাতে রোগ সারছে কি না, তা নিয়েও মাথা ঘামাননি কেউ।
এ পর্যন্ত সব ‘ঠিকঠাক’ই ছিল। বাদ সাধল হুগলির জেলা স্বাস্থ্য-অধিকর্তার একটি অভিযোগ। অ্যালুমিনিয়ামের মোড়ক না-থাকায় ওষুধগুলো কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন ওই অফিসার। তাতেই টনক নড়েছে স্বাস্থ্য ভবনের। গত ২২ জুন স্বাস্থ্য দফতরের তরফে থেকে প্রতি জেলার স্বাস্থ্য-অধিকর্তার অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কাগজে মোড়া ট্যাবলেটের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের কথায়, “ওষুধের মানরক্ষার অন্যতম শর্ত হল ঠিকঠাক প্যাকেজিং। এখানে নিয়ম মানা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ওষুধ তুলে নেওয়া হচ্ছে। উৎপাদক সংস্থাটিকে আমাদের অফিসারদের সামনে সব ওষুধ নষ্ট করে ফেলতে হবে।” এত বড় অনিয়ম ঘটল কী ভাবে?
উৎপাদক সংস্থাটির কর্ণধার বিজয় অগ্রবালের ব্যাখ্যা, “টেন্ডারে লিখিত নিয়মাবলির মধ্যে প্যাকেজিংয়ের শর্তটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।” এ দিকে জেলায়-জেলায় বহু রোগী তো ওই ওষুধ খেয়েছেন! তাঁদের যদি শারীরিক ক্ষতি হয়? স্বাস্থ্য-কর্তাদের স্বীকারোক্তি, সেটা যাচাই করার পরিকাঠামো সরকারের নেই। তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, টেন্ডারে দর সবচেয়ে কম দিয়েই গড়িয়ার সংস্থাটি প্যারাসিটামল-পেনকিলার সরবরাহের বরাত পায়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কম দাম, না ভাল মান?
বস্তুত এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। আর তাকেই নতুন করে উস্কে দিল এই ঘটনা। স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ এবং ওষুধশিল্পের ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলির সংগঠনের অভিযোগ, সরকারি বরাতলাভের তাগিদে অত্যন্ত কম দামে ওষুধ জোগাতে গিয়েই বিভিন্ন সংস্থা মানের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। স্বাস্থ্য-সূত্রের তথ্য: গত বছর সরকার এক-একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কিনেছিল ২২ পয়সা দরে। এ বছর গড়িয়ার সংস্থাটি তা দিয়েছে ১৮ পয়সায়। ব্যথা উপশমের ট্যাবলেট গত বছর কেনা হয়েছিল ২৪ পয়সা দরে, এ বার দাম পড়েছে ১৯ পয়সা। ‘স্মল স্কেল ড্রাগস ম্যানুফ্যাকচারার্স কমিটি’র পদাধিকারীরা এর মধ্যেই সমস্যার উৎস খুঁজে পাচ্ছেন। “এক বছরে দাম বাড়তে পারে। কমে না। এত কম দামে ভাল জিনিস দেওয়া অসম্ভব।” বলছেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ জানিয়েছেন, রাজস্থান-গুজরাত-দিল্লি-তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে সরকারি হাসপাতাল রোগীদের ওষুধ দেওয়ার আগে তা পরীক্ষা করিয়ে নেয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে তার বালাই নেই। গোটা রাজ্যে ওষুধ পরীক্ষার সবেধন নীলমণি যে সরকারি ল্যাবরেটরি, কনভেন্ট রোডের সেই পরীক্ষাগারের পরিকাঠামো শোচনীয়। কী রকম?
অভিযোগ: সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা কোনও ওষুধের নমুনা ওখানে পাঠানো হলে রিপোর্ট মিলতে বছর গড়িয়ে যায়। যেমন, ২০১০-এ কোচবিহার জেলা মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে অ্যালার্জি নিরাময়ের একটা ওষুধ এবং ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছিল ড্রাগ কন্ট্রোল। সেগুলোকে ‘অসম্ভব নিম্নমানের’ অ্যখ্যা দিয়ে রিপোর্ট যখন এল, তত দিনে জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে তা ব্যবহার করা হয়ে গিয়েছে। এমন উদাহরণ অজস্র।
তাই প্রশ্ন উঠেছে, মান যাচাই করা কার্যত অসম্ভব হওয়া সত্ত্বেও ওষুধ কেনার সময়ে কম দামকে প্রাধান্য দেওয়া হবে কেন?
অসিতবাবুর বক্তব্য, “মান বিচারের পরেই তো ড্রাগ কন্ট্রোল কোনও ওষুধকে বাজারে বিক্রির ছাড়পত্র দেয়! তা ছাড়া সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের নিয়ম, যারা টেন্ডারে সবচেয়ে কম দর দেবে, ওষুধের বরাত তারাই পাবে। সেটাই মানা হয়েছে।” |