এত বড় একটা টুর্নামেন্টের ফাইনালে চার গোল! কেউ কোনও দিন শুনেছে না ভেবেছে? আধুনিক ফুটবলে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। শেষ মনে পড়ছে ’৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল। যেখানে জিদানের ফ্রান্স তিন গোল দিয়েছিল ব্রাজিলকে।
ম্যাচ রিপোর্টটা লিখতে বসে তাই আফসোসই হচ্ছে। সামনাসামনি মহাতারকাদের দেখব বলে আমি বেশ কয়েক বার ইউরোপ গিয়েছি। ’৮২ বিশ্বকাপ ফাইনালে মাদ্রিদের স্টেডিয়ামে ছিলাম। ’৯০ বিশ্বকাপ দেখতে ছুটেছি ইতালিতে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এই ইউরো দেখতে ইউক্রেনে যাওয়া উচিত ছিল। স্রেফ স্পেনের এই ফুটবল দেখতেই তো হাজার হাজার মাইল হাঁটা যায়। ঠিক ব্রাজিলের মতোই। ইউরো চলার সময় শুনছিলাম অনেকে বলছেন, স্পেনের ফুটবল ‘বোরিং’ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বকাপে যে পাসের ঝড়, মাঝমাঠের সৃষ্টিশীলতা দেখা যাচ্ছিল, ইউরোয় সে সব আর পাওয়া যাচ্ছে না দেল বস্কির টিমে। জানার ইচ্ছে আছে, রবিবারের স্পেনকে দেখে এঁরা কী বলেন। স্বপ্নের ফুটবল কাকে বলে সেটা এত দিন মারাদোনার খেলা থেকে বুঝেছি। পেলে-গ্যারিঞ্চার ব্রাজিল সেটা দেখিয়েছে বার বার। ইউরো ফাইনাল চলার সময় শুনছিলাম কমেন্ট্রি বক্সে বলাবলি হচ্ছে, স্বপ্নের ফুটবল। নির্ভেজাল সত্যি। সোজাসুজি বলি, এই স্পেনকে স্বচ্ছন্দে ইউরোপের ‘ব্রাজিল’ বলা চলে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে ‘জোগা বোনিতো’ বলে যে শব্দটা আছে, সেটা অনায়াসে এ বার অনায়াসে বসানো যায় ইনিয়েস্তাদের ফুটবলের পাশে। আজকের পর দেল বস্কির টিমকে সর্বকালের অন্যতম সেরা টিম বলতেও আমি রাজি। পরপর দু’বার ইউরো। মাঝে বিশ্বকাপ। একটা টিমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে আর কী দরকার পড়ে? সর্বকালের সেরা টিম বলতে এত দিন বোঝাত ’৫৮-তে পেলের ব্রাজিল। ’৭৪-এ বেকেনবাউয়ারের জার্মানি। ’৮৬-তে মারাদোনার আর্জেন্তিনা। বা ’৫৪-তে পুসকাসের হাঙ্গেরি। রবিবারের পর ইনিয়েস্তা-জাভিরাও ওই লিস্টে ঢুকে গেল। আমার তো মনে হয়, মারাদোনার আর্জেন্তিনাও হেরে যেত এই স্পেনের কাছে। |
স্পেন কি ফাইনালের জন্যই নিজেদের সেরা ফুটবলটা তুলে রেখেছিল? রবিবারের পর এই প্রশ্নটা শুনতে হতে পারে। আমি বলব, শুধু গতিটা মারাত্মক বাড়িয়ে দিয়েছিল স্পেন। সঙ্গে যোগ হয়েছিল দুর্ধর্ষ স্কিল। সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিরুদ্ধে যে ছন্নছাড়া লাগছিল ওদের, তার কারণ পতুর্গিজরা ডিফেন্সটা অনেক ভাল সামলাচ্ছিল ইতালির চেয়ে। খুব সহজে ফাইনালে স্পেনের জয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি:
এক) মাঝমাঠের দখল: এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা মাঝমাঠ স্পেনের। ইনিয়েস্তা-জাভিদের এখন পাস বাড়ানোর সময় কিছু ভাবতে হয় না। অনেকটা যেন ‘টেলিপ্যাথি পাসিং’। এক জন কী চাইছে, সেটা অন্য জন অনায়াসে বুঝতে পারছে। ইতালি যে ম্যাচ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, তার কারণ শুরু থেকে মাঝমাঠের দখল হারানো। ইনিয়েস্তা-আলন্সো-জাভিরা ঢেউয়ের মতো উঠে আসছিল ইতালি বক্সে। বিশেষ করে বলব ইনিয়েস্তার কথা। ওকে দেখে আজ মিশেল প্লাতিনির কথা মনে পড়ছিল। কী অনবদ্য পাসিং! প্লাতিনি যে ভাবে বল ধরত, নিখুঁত ভাবে সেটা সাজিয়ে দিত স্ট্রাইকারের জন্য, একই কাজটা ইনিয়েস্তাকে করতে দেখলাম। প্রথম গোলটার ক্ষেত্রেও কিন্তু ইনিয়েস্তার অপূর্ব পাসটা ছিল।
দুই) বালোতেলি বোতলবন্দি: আক্ষরিক অর্থেই তাই। ফাইনালের প্রিভিউতেই লিখেছিলাম, জার্মানদের মতো অনভিজ্ঞ ডিপ ডিফেন্স স্পেনের বিরুদ্ধে পাবে না বালোতেলি। ও ড্রিবল করতে পারে না সে ভাবে। বালোতেলির দক্ষতা শ্যুটিং। কিন্তু ওকে আজ বল ছুঁতেই দেয়নি স্পেনের দুই ডিফেন্ডার রামোস এবং পিকে। বালোতেলি চুপ করে যেতে ইতালির যাবতীয় কারিকুরিও থেমে গেল। |
তিকিতাকা ঝড়ে ভূপতিত বালোতেলি। |
তিন) দুর্ভেদ্য কাসিয়াস: প্রথম গোলটা হজম করার পর ইতালি কিন্তু তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছু করতে পারেনি কাসিয়াসের দক্ষতায়। মাঝে একটা সময় প্রায় মিনিট দশ-পনেরো একাই ইতালির আক্রমণ ঠেকিয়ে দিল কাসিয়াস। কাসানোর শট বাঁচাল। বালোতেলির মাথা থেকে একটা বল ছোঁ মেরে তুলে নিল। সারাক্ষণ তাতিয়ে গেল টিমকে। এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর গোলকিপারের শিরোপা ওকেই দিতে হবে। গ্রুপ লিগে শুধু ইতালির বিরুদ্ধে ম্যাচটা ছাড়া প্রায় সওয়া পাঁচশো মিনিট অপরাজিত থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করল স্পেনের অধিনায়ক।
চার) টিমটার নিউক্লিয়াস ধরে রাখা: এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবল যে জায়গায়, প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন টিমে রদবদল হয়েই চলেছে। সে দিক দিয়ে দেখলে স্পেন টিমটায় কিন্তু ২০০৮ ইউরোর পর খুব বদল হয়নি। মূল তারকারা যে যার নিজের জায়গায় থেকে গিয়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপের টিমটাই ধরুন। ওই টিম থেকে শুধু প্রথম এগারোয় নেই দাভিদ ভিয়া ও কার্লোস পুওল। এই টুর্নামেন্টের আগে ফর্মে না থাকা তোরেস আর ফ্রাবেগাসকে দিয়ে পুরো টুর্নামেন্টটা চালিয়ে দিলেন দেল বস্কি। ভেবে দেখুন, যদি ভিয়া থাকত তা হলে আরও কত ভয়ঙ্কর হতে পারত স্পেন!
|