রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণের ‘ছায়া’ সরাসরি এসে পড়ল রাজ্য বিধানসভায়। কংগ্রেস এবং তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তাঁদের ‘বন্ধু’ বলে বক্তৃতার মাঝেই সিপিএমকে কটাক্ষ করলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে তিনি অবশ্য রাজ্যে জোট সরকারের বিধায়কদের ‘সতর্ক’ করে বলেছেন, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে ‘বিভাজন’ তৈরি করাই সিপিএমের নীতি। জোট শিবিরের বিধায়কেরা যেন সেই ‘ফাঁদে’ পা না-দেন।
এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে বিভাজনের সুযোগ নেওয়াই যে রাষ্ট্রপতি-পদে তাঁদের প্রণববাবুকে সমর্থন করার অন্যতম কারণ, নিজেই সম্প্রতি সে কথা স্পষ্ট করেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। সেই অর্থে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কারাটের যুক্তিতেই সিপিএমকে বিঁধেছেন!
তবে রাজ্য কংগ্রেসকে ওই ‘সতর্কবাণী’ দিলেও মুখ্যমন্ত্রী যে কেন্দ্রীয় সরকার তথা কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের আচরণে ‘ক্ষুব্ধ’, এমন ‘বার্তা’ তাঁর মন্তব্যে স্পষ্ট। প্রসঙ্গত, কংগ্রেস-সিপিএমকে এক বন্ধনীতে ফেলে পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের তরফে প্রচার ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
বিধানসভায় শুক্রবার পুলিশ বাজেট-বিতর্কে জবাবি বক্তৃতা করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা। তাঁর বক্তৃতার সময় শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্য ঘিরে উত্তেজনাও ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের মাঝেই সিপিএমের এক বিধায়ক প্রশ্ন করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার এত অস্বাভাবিক কেন? টাকার অবমূল্যায়ন কেন হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত জবাব দেন, “আপনি দিল্লিকে জিজ্ঞেস করুন! আপনার বন্ধু তো!”
পরে আরও এক বার একই ভাবে সিপিএমকে কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বাজেট-বিতর্কে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখিয়ে রাজ্যের সাম্প্রতিক ‘শান্ত’ পরিস্থিতির কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তৃণমূল বিধায়ক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। জবাবি বক্তৃতায় তার সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তাঁর জমানায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ অনেক কমেছে। মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়েও অভিযোগ ঠিক নয়। তখনই সিপিএমের এক বিধায়ক প্রশ্ন ছোড়েন, তা হলে জাতীয় মহিলা কমিশন এ রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে কেন? এ বারও মুখ্যমন্ত্রীর ঝটিতি জবাব, “দিল্লি আপনার বন্ধু! আপনি জিজ্ঞেস করুন না!” এর কোনও পাল্টা জবাব বিরোধী শিবির তখন অন্তত দিতে পারেনি।
রাষ্ট্রপতি-পদে ইউপিএ প্রার্থী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করছে সিপিএম এবং তাদের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। প্রণববাবুর জমানায় রাজ্যের জন্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে বারংবার দরবার করেও কোনও সুরাহা হয়নি বলে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। সুযোগ পেয়ে এ দিন কৌশলে সিপিএম-কংগ্রেসের ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে কটাক্ষ করে সেই ক্ষোভই মুখ্যমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের ব্যাখ্যা। তবে মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষের কোনও জবাব কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে আসেনি। কংগ্রেস-সিপিএমের ‘বন্ধুত্ব’ সংক্রান্ত প্রচার এ রাজ্যের রাজনীতিতে দু’দলের পক্ষেই ‘অস্বস্তিকর’। সেই ‘বাস্তবতা’ জেনেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী এমন কৌশল নিয়েছেন।
তবে দিল্লির কংগ্রেস ও সিপিএমকে কটাক্ষ করার পরেই রাজ্যে জোট শরিক কংগ্রেসকে ‘পাশে টানা’র চেষ্টাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “আমাদের তৃণমূল এবং কংগ্রেস বিধায়কদের বলছি, প্ররোচিত হবেন না। পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করা ওদের কৌশল। সিপিএমের খেলাকংগ্রেস-তৃণমূল লাগিয়ে দাও! আপনারা ফাঁদে পা দেবেন না!” বস্তুত, রাজ্য কংগ্রেসকে ‘পাশে’ রাখার কৌশলী চেষ্টা এ দিন করেছেন ‘জোট-নেত্রী’ মমতা। বাজেট-বিতর্কে আলাদা করে কংগ্রেস বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর বক্তব্য উল্লেখ করে তার জবাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর এক কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী অবশ্য পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড টেনে এনেছিলেন। তবে মনোজবাবু একে অধীর চৌধুরীর জেলা মুর্শিদাবাদের বিধায়ক, তায় ‘বিদ্রোহ’ করে রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগী। ফলে তাঁর বক্তব্যকে সেই আলোকে দেখাই শ্রেয় বলে অভিমত তৃণমূলের।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ‘রাজনৈতিক’ আক্রমণ করেন প্রবীণ সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে। প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী রেজ্জাক বাজেট-বিতর্কে বলেছিলেন, “জঙ্গলমহলে তুষের মতো ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে! যে কোনও দিন বড় হয়ে যেতে পারে!” জবাবি ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, “মাওবাদী-নকশালদের সঙ্গে রেজ্জাক সাহেবের ভাব হয়েছে আজকাল! এখন আপনাদের মুখোশ খুলে যাচ্ছে! জঙ্গলমহলে শান্তি আছে। এতে আপনার রাগ হচ্ছে কেন?” সিঙ্গুরের ‘জমি দখল’ করতে ৩ জুলাই সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সঙ্গেই অভিযানে যাওয়ার ঘোষণা করেছেন রেজ্জাক। মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল সেই দিকেই। |