বাম আমলের ধার ও তার উপরে চাপানো সুদের বোঝা থেকে তিন বছরের জন্য ‘নিষ্কৃতি’ চেয়ে এত দিন তিনি একাই দরবার করেছেন কেন্দ্রের কাছে। এ বার সেই কাজে সঙ্গী হতে বামেদের কাছেও অনুরোধ জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত, শুধু বামই নয়, বিধানসভায় এ দিন মমতা সব দলের কাছেই একই অনুরোধ রাখেন। পাশাপাশি সব দলকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘মোরাটোরিয়ামের’ জন্য কেন্দ্রের দ্বারস্থ হতে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ‘তৎপর’ হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
এই ‘মোরাটোরিয়াম’ নিয়ে অসন্তোষেই প্রণববাবুর সঙ্গে গত প্রায় ছ’মাস বাক্যালাপ বন্ধ মমতার। যার ‘ছায়া’ পড়েছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও। প্রণববাবুকে সমর্থন করতে রাজি হননি মমতা। পক্ষান্তরে, প্রণববাবুকে সমর্থনে রাজি হয়ে গিয়েছে সিপিএম। তৃণমূল শিবির যে উদাহরণ টেনে আবার ‘কংগ্রেস-সিপিএম সম্পর্কে’র কথা তুলছে। আবার প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা যখন বলছেন, রাজ্যের প্রবীণ রাজনীতিক প্রণববাবুকে সমর্থন করা উচিত ছিল মমতার, তখন তৃণমূলও পাল্টা বলছে, এত দিন ওঁরা ছিলেন কোথায়? প্রণববাবুর কাছে সুদ মুকুব করা নিয়ে কিছু লেখেননি কেন? আরও বলছে, রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা কেন বলছেন না যে, প্রণববাবুর সিপিএমের সমর্থন চাওয়া উচিত হয়নি?
এই পরিস্থিতিতে এ দিন মমতার ওই ‘আবেদন’।
বিধানসভায় শুক্রবার প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকারের কাজ চালাতে হচ্ছে। আরও কাজ করব। সভার কাছে আমার একটাই আবেদন, আসুন তিন বছরের মোরাটোরিয়ামের জন্য কেন্দ্রের কাছে সকলে মিলে অনুরোধ করি। আসুন সকলে একসঙ্গে বসি। আপনাদের সহযোগিতা চাই।” তত ক্ষণে অবশ্য অন্য একটি বিষয়ে বিরোধীরা ওয়াকআউট করে গিয়েছেন। বিরোধী-শূন্য সভায় মমতা বলেন,
বাম-জমানার ঋণের সুদ-বাবদ বার্ষিক ২৫ হাজার কোটি টাকা করে কোষাগার থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেটে নিচ্ছে! তাঁর কথায়, “রাজ্যের আয় বার্ষিক ২১ হাজার কোটি টাকা। ওই সুদ মিটিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন-কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।” তবে এই ঋণে কেন্দ্রের দায়ও যে রয়েছে, তার ইঙ্গিত দিয়ে মমতার অভিযোগ, “বাইরের ঋণ কেন্দ্র অনুমোদন না করলে বামফ্রন্ট এতটা ঋণ নিতে পারত না।” ঋণ মেটানোর জন্য কেন্দ্রের কাছে বাড়তি অর্থের দাবি জানাননি মমতা। বরং ‘মোরাটোরিয়াম’ মঞ্জুর হলেই তাঁর সরকার ‘অসম্পূর্ণ’ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে বলেই তিনি জানিয়েছেন। |
তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই আবেদনে ‘সহমত’ নন বিরোধীরা। তাঁদের যুক্তি, ‘মোরাটোরিয়ামে’র দাবির কোনও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “মোরাটোরিয়াম ছাড়া বাকি আর্থিক দাবিদাওয়ার জন্য আমরা একসঙ্গে যেতেই পারি। মুখ্যমন্ত্রীর এই আবেদনের অনেক আগেই রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া ও ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।” তবে সূর্যবাবু জানিয়েছেন, বিরোধী দলও সরকারকে সাহায্য করতে চায়। তাঁর কথায়, “বিরোধী পক্ষে রয়েছি বলেই বিরোধিতা করতে চাই না।” রাজ্যকে তাঁর পরামর্শ, “দিল্লিতে দরবার করতে যাওয়ার আগে কী দাবি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা সরকারের এখানে আলোচনা করে যাওয়া দরকার।”
সরকারের শরিক কংগ্রেস অবশ্য রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থা কাটাতে আলোচনায় বসতে ‘আগ্রহী’। মমতার আবেদনকে ‘স্বাগত’ই জানান পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব। তবে পাশাপাশি সভায় সোহরাব অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে আগে আলোচনার আর্জি জানিয়েও তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে জবাব পাননি! প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতা’র এমন অভিযোগে ঈষৎ ‘ক্ষুণ্ণ’ মমতার পাল্টা জবাব, “আপনি আমার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তদানীন্তন অর্থমন্ত্রীর (প্রণববাবু) সঙ্গে এ ব্যাপারে অনেক বার আলোচনা করেছি। আপনাদের দলনেত্রীর (সনিয়া গাঁধী) সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আপনাদের দলের কেন্দ্রীয় স্তরে আলোচনা করার পরেও রাজ্য স্তরে আলোচনা করতে হবে, বুঝিনি!”
তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা যে ‘তাস’ খেলেছেন, তাতে ‘সহযোগিতা’র আশ্বাস ছাড়া বিরোধী বা শরিকের উপায় ছিল না। দলের এক সাংসদের কথায়, “যাঁকে সমর্থন করল সিপিএম, তিনি যে এত দিন রাজ্যকে বঞ্চিত করেছেন, সেটা তো পরোক্ষে হলেও ওঁরা স্বীকার করলেন!” |