|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
আপন মনের মাধুরী মেশানো সৃষ্টি |
বারিদবরণ ঘোষ |
লোকজ শিল্প, সম্পাদনা: বরুণকুমার চক্রবর্তী। পারুল, ৬৯৫.০০ |
কোনও স্মরণাতীত কালের কথা বলতে গেলে আমরা বলি ‘মান্ধাতার আমল’। মান্ধাতার আমল থেকেই আমরা বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে চলেছি। কিন্তু এই কাজকে জড়িয়েই যখন আমরা কারুকর্ম করি অথবা বলি চারুময়তা সৃষ্টি করি— তখন তা প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি ছাড়িয়ে অপ্রয়োজনের আনন্দ এনে দেয়। কাঠ-বাঁশ-বাখারি-দড়ি-খড় দিয়ে ঘরের চাল তৈরি করলে শীত-আতপ-বর্ষা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু ঘরের সরদলটার লম্বা কাঠের শেষে যখন একটা হাতির মুখের আদল তৈরি করি, তখন সেটাতে দরকারি কাজ কতটা হয় জানি না, কিন্তু আপন মনের মাধুরী মেশানো একটা সৃজন ঘরকে ছাপিয়ে বিশ্বকে সমীপবর্তী করে দেয়। কোনও এক মন-কেমনের মুহূর্তে ওই কাঠের হাতির মুখটা দিগগজ হয়ে, জল ছড়িয়ে, মাতামাতি করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তোলে।
দিনযাপনের গ্লানি এমনি করেই ধুয়ে-মুছে যায় মানুষের শিল্পিত স্বভাবের গুণপনায়। এই ব্যক্তিস্বভাব যখন লোকস্বভাবের সামগ্রী হয়ে পড়ে, তখনই গড়ে ওঠে একটা ঘরানা। আমরা তার নাম দিই শিল্পধারা। আধার বা সামগ্রী ভেদে শিল্পের চরিত্র বদলে যায়। কাঠ-মাটি-ধাতু-সুতো শিল্পের বিচিত্র কারুকর্মে আর কাঠ-মাটি-বাঁশ-বেত থাকে না— হয়ে যায় এক মনোময় আধার। সৃজক এবং দর্শক দু’জনেই এক অপরা-আশ্রয়ের স্বস্তি পান, ভরে ওঠে মন কানায়-কানায়। সে দিন কাঁথি অঞ্চলের ‘ঝুঁটি’ আলপনার কথা হচ্ছিল। ছোটবেলায় পাড়ায় ছোটদের কোন্দলে কিশোরীর ঝুঁটিতে কতবার আকর্ষণ দেখেছি— কিন্তু তা যে আলপনার ব্রত হয়ে উঠতে পারে, একটা বিশেষ মূর্তি নির্মাণের শিল্পিতস্বভাবে একটা সম্প্রদায়ের নামই হয়ে ওঠে ডোকরা, যে-কাঁথায় শুয়ে শিশু তার ‘ওম’টির আশ্রয় পায়— তার নকশিতে সে কী আনন্দ পায় জানি না, কিন্তু এর কারিগর আর সমঝদারে মিলে যা গড়ে তোলেন তার পরিমাপ করবে কে?
চিরবাহিত চিত্রকর্ম দেখতে আমরা গুহাভ্যন্তরে প্রবেশ করি নানা আয়াসে, ভাস্কর্যের মাধুর্য আস্বাদনের জন্যে আমরা মাধুকরী করি চিত্তের। কিন্তু মূলস্রোতের পাশে বয়ে যাওয়া প্রতিস্পর্ধী লোকজ শিল্পের সঙ্গে আমাদের নিতুই জানা-চেনা— এর জন্যে পৃথক পরিচয়-যাত্রার প্রয়োজন হয় না। যে বাঁশের পলুইটি নিয়ে মেছেনি মাছ ধরতে যান, ডোকরা শিল্পের ছাইদানিকে যিনি ভস্মাধার করেন, ঘুনি-বেতের চাদরে যিনি শয্যাশ্রয় করেন, কুকুর কি বেড়ালমুখো ছড়ি ধরে যিনি চলার ভারসাম্য রাখেন— তিনি একবারও ওই রকম একটা গান গেয়ে থাকেন কৃষ্ণনগর থেকে আমি কৃষ্ণ কিনে এনেছি! এই যে লোকজ শিল্পধারা, যা শুধু লোকজ নয়, লোকের জন্যেও, তা সোচ্চার নয়। কিন্তু এই ধারা নীরবে একটা ঐতিহ্যকে প্রবহমান করে রেখেছে। বিয়েবাড়ির ভোজের শেষে পান খেতে গিয়ে যখন দেখি পানের ধারগুলি চিরে একটা শিল্পকর্ম রুচিময়— তখনই বুঝি এক বিপুল লোকরুচি অন্তঃশায়ী হয়ে জাতির চিত্তসমৃদ্ধিকে সজাগ করে রেখেছে।
এই সাধারণ জনবাহিত-চর্চিত শিল্পধারাকে সমবায়িত করে একটি গ্রন্থের জন্য আমাদের প্রত্যাশা ছিল। পূর্বে যাঁরা ভেবেছেন এবং বর্তমানে যাঁরা এক লোক-ঐতিহ্যকে বহনযোগ্য ভাবছেন, তাঁদের মূল্যবান রচনাদি একত্র করে, আধার অনুসারে বিন্যস্ত করে সম্পাদক বিশ্রুত লোকসাহিত্যবিদ বরুণকুমার চক্রবর্তী বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি একই কালে দায়বদ্ধতা স্বীকার এবং তাকে বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভাবুকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে একটি মহত্তর কর্ম সম্পাদন করলেন। লোকচিত্রকলা, ধাতু, বাঁশ-বেত-মাটি-কাঠ-বয়ন এবং অন্যান্য লোকাশ্রয়ী শিল্পকর্ম নিয়ে লেখা প্রায় পঞ্চাশৎ প্রবন্ধ সংকলন করেছেন তিনি। লেখকদের মধ্যে দিব্যজ্যোতি মজুমদার, প্রদ্যোত ঘোষদের মতো পরিচিতজন থাকলেও এই বইয়ের গৌরব নবীনদের রচনামালিকায় বিধৃত। গ্রন্থশেষে এঁদের পরিচিতি না থাকলেও এই গবেষণা— যা মূলত ক্ষেত্রসমীক্ষা-নির্ভর— এঁদের লোকজ শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে একটা মর্যাদার আসন দেবেই।
শুধু উভয় বাংলা নয়, লোকজ শিল্পসূত্রে স্বজন ত্রিপুরাও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। কেমন করে আহার্য বস্তু শিল্পিত হয়— গহনাবড়ি তার সেরা নমুনা। বিলীয়মান শঙ্খশিল্প কত দিন আর ‘আধুনিক’ আক্রমণে জীবিত থাকবে জানি না, কিন্তু সম্ভবত সন্দেশের ছাঁচ দীর্ঘদিন তার স্বাদ বাড়িয়ে চলবে। জানি না, বারবি ডল-এর প্রতাপে কৃষ্ণনাগরিক পুতুলশিল্পের নাভিশ্বাস উঠবে কি না, সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও পাটশিল্প কত দিন নাইলন-পলিথিনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে কি না! পট এবং ডোকরাশিল্পের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে। বাঙালি যত দিন বাঙালি থাকবে তত দিন দুর্গা-লক্ষ্মী সরা, ‘বেতের বোনা ধামা-কুলো’, উঠোনবিহীন ঘরের কোণে তুলসীমঞ্চ বা শোলাশিল্প বেঁচে থাকবে হয়তো। আর বেঁচে থাকবে এই সংকলন। বিষয়ের মতোই এর গ্রন্থনা ও মুদ্রণ সুচারু। লেখকের রুচি আর প্রকাশকের মর্জির এমন মেলবন্ধন দুর্লভ। |
|
|
 |
|
|