পুস্তক পরিচয় ১...
জাতীয় ইতিহাসের ভণিতা করেননি
বীরভূমের ইতিহাস, গৌরীহর মিত্র, সম্পাদনা: পার্থশঙ্খ মজুমদার। আশাদীপ, ৪৫০.০০
ক সময় বাংলায় জেলা-ভিত্তিক আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার মূলে কাজ করেছিল স্বাজাত্যবোধ, যা কিনা জাতীয়তাবাদের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজ শাসন প্রাথমিক ভাবে ভদ্রশ্রেণির কাছে আংশিক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বাঙালির অবদমিত প্রতিবাদস্পৃহা রূপ নিতে চেষ্টা করেছিল দ্বিবিধ উপায়ে— একটি সাহিত্য, অন্যটি ইতিহাস চর্চা। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসনে বাঙালির গৌরব বলতে এক দিকে যেমন বলেছিলেন ‘বাংলা সাহিত্য’ (অবস্থা ও ব্যবস্থা), অন্য দিকে তেমনই স্বাগত জানান ‘ইতিহাস-উৎসাহ’কে। (ভারতী ১৮৯৯)। পার্থ চট্টোপাধ্যায় জাতীয়তাবাদ বিশ্লেষণে একেই বলেছেন ‘ইনার ডোমেন’।
আঞ্চলিক ইতিহাসের সংজ্ঞা অবশ্য বিতর্কিত। জেলা, মহকুমা, গ্রাম-জনপদ সবই অঞ্চল হতে পারে। সর্বনিম্ন একক হিসেবে গ্রামীণ ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ লা দুরি-র মতাঁয়ু (ইংরেজি অনুবাদ ১৯৭৯)। তুলনীয় না হলেও, গ্রামীণ জীবনের এক ‘ক্রনিকল’ বা বিবরণ লিখেছিলেন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (বীরভূম বিবরণ ৩ খণ্ড, ১৯১৬-’২৭)। হান্টারের দি অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল (১৮৬৮) এই আলোচনায় আসছে না, যেহেতু বাঙালি-বিরচিত নয়। কিন্তু অঞ্চলের ইংরেজি প্রতিশব্দ যদি ‘রিজিয়ন’ ধরা হয়, তবে বাংলায় আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ববিদ ঐতিহাসিক বার্নার্ড কোন্-এর ব্যাখ্যা অধিকতর প্রযোজ্য। তিনি আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত ভাগকে চিহ্নিত করেছেন। সন্দেহ নেই ভারতবর্ষের এই বিভিন্নতাগুলি ভারতীয় ইতিহাসকে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করে। কেন্দ্রীয় শাসনের মধ্যে থেকেও বাংলা বা অন্যান্য অঞ্চল যে তাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্রে বিকশিত হয়েছিল, এটি তার প্রমাণ। কোন্ কথিত প্রায় সমস্ত ভাগ অখণ্ড বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জেলা-ভিত্তিক গবেষণার বিস্তার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্যেরই স্বীকৃতি এবং তার বিশ্লেষণী আলোচনা এখন পূর্ণাঙ্গতা লাভের পথে অগ্রসর।
ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাসের পরম্পরায় আঞ্চলিক ইতিহাসেরই প্রাধান্য। প্রাচীন পর্বে মৌর্য ও গুপ্ত যুগের সীমিত অবস্থান থাকলেও বাংলায় পাল-সেন, পশ্চিমে গুর্জর-প্রতিহার এবং দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট, চোল, চালুক্য এবং পহ্লব রাজ্যগুলি স্ব-স্বাতন্ত্রে ছিল দেদীপ্যমান। মুঘল যুগেও আনুগত্য ও কর দেওয়া ছাড়া রাজ্যগুলির স্বশাসনে আপাতবাধা ছিল না। ইংরেজ শাসনেই তার ‘রুল অব ল’ পৌঁছে গেল ভারতের প্রত্যন্ত সীমায় সীমায়, আর তার ফলে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের ঘটল অবসান। যদিও কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ঔপনিবেশিক আমলেও জেলায় বা গ্রামাঞ্চলে জমিদার বা স্থানীয় জোতদাররাই ছিলেন প্রকৃত শাসক। ইংরেজ তার নিজের প্রয়োজনেই খোঁজ শুরু করল অতীতের আঞ্চলিক তারতম্য-বিধৌত ভারত ইতিহাসের। শাসন সুদৃঢ় করতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন, তা ফুকোর অনেক আগেই হেস্টিংস বুঝেছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এভরি অ্যাকুমুলেশন অব নলেজ ইজ ইউজফুল টু দ্য স্টেট...’। বাংলায় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হান্টারের ‘অ্যানালস’।
ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মেই প্রতিক্রিয়া অনিবার্য, আর তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জেলার ইতিহাস চর্চায় এক ধরনের ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও দেখা গেল দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। নিজেকে জানার তাগিদ থেকে সাম্যতাভিমানের যে প্রকাশ ঘটল, তার অবস্থান কিন্তু ইংরেজ শাসকের জ্ঞান চর্চার বিপ্রতীপে। এ বিষয়ে পথিকৃৎ কালীকমল সার্বভৌমের সেতিহাস বগুড়ার বৃত্তান্ত (১৮৬১)। তখনও বঙ্কিম বাঙালির ইতিহাস লেখার আহ্বান জানাননি। একে একে প্রকাশিত হয় নিখিলনাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনী (১৯০২), সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর-খুলনার ইতিহাস (১৯১৪-’২৩) ইত্যাদি। বীরভূম জেলার ইতিহাস চর্চার এক নিজস্ব প্রবণতা ছিল। অর্ণব মজুমদার এ বিষয়ে বীরভূম: ইতিহাস ও সংস্কৃতি (২০০৬) বইয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। যথা, বীরভূম রাজবংশ (১৯০৮-০৯), বীরভূমের ইতিহাস (১৯১১) এবং বীরভূম বিবরণ ইত্যাদি। তবে এগুলিকে ইতিহাস না বলে বিবরণ বলাই সঙ্গত। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের নামই বীরভূম বিবরণ এবং তিনি নিজেকে ঐতিহাসিক বলে দাবিও করেননি। সেই অর্থে গৌরীহর মিত্রের বীরভূমের ইতিহাস (১৯৩৬-’৩৮) বীরভূমের প্রথম প্রামাণিক ইতিহাস-গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। ২০০৫-এ অরুণ চৌধুরির সম্পাদনায় বীরভূমের ইতিহাস (রাঢ়) দুই খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হয়। এ বার পার্থশঙ্খ মজুমদারের সম্পাদনায় গৌরীহর পরিকল্পিত তৃতীয় খণ্ডের লেখাগুলি সহ বইটি প্রকাশিত হল। গৌরীহর পেশাদার ঐতিহাসিক ছিলেন না এবং তাঁর ইতিহাস রচনার প্রেরণা পিতা শিবরতন মিত্র। তিনি তাঁর অদম্য নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে অজস্র পুঁথি ও সাহিত্য গ্রন্থ সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘রতন লাইব্রেরি’ (১৯০৯)। এ হেন পিতার পুত্র যে স্ব-ভূমির ইতিহাস রচনায় ব্রতী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কঠোর দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি এই পুস্তক রচনা করেন। বই প্রকাশও করেন নিজের ব্যয়ে।
সম্পাদকের কথা ও নির্দেশিকা-সহ আলোচ্য সংস্করণের পৃষ্ঠা-সংখ্যা ৬৪০। গ্রন্থটি তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে জেলার অবস্থান ও সীমানা। ‘হিন্দু ও মুসলমান অধিকার’ কালের ইতিহাস-সহ প্রাচীন পল্লিচিত্র ও গ্রাম্যগীতিকা। দ্বিতীয়াংশে ইংরেজ অধিকারে পাশ্চাত্য বণিকদের আগমন-সহ সাঁওতাল বিদ্রোহ পর্যন্ত। এর আবার দু’টি প্রস্তাব। সঙ্গে যুক্ত বিদ্রোহ সংক্রান্ত একটি অসাধারণ গ্রাম্যগীতিকা। তৃতীয় খণ্ডটি সম্পাদক সাজিয়েছেন এই ভাবে, যথা— অর্থনীতি যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বীরভূমের শিল্প, খনিজ সম্পদ, তসর ও কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং অতি সংক্ষিপ্ত হলেও এই জেলার জলপ্রণালী। সমাজ অংশে আছে বীরভূমের জাতি-প্রসঙ্গ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প অংশে রয়েছে জ্ঞানদাস ও অন্যান্য পদকর্তার নতুন পদ, বাউল, স্থাপত্য ও কারুশিল্প, জয়দেব প্রসঙ্গ, মেলা, প্রাচীন পল্লিচিত্রের আরও কিছু আভাস এবং গেজেটিয়ার অনুসরণে কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্থানের বিবরণ। এক দিকে ধারাবাহিক এবং অন্য দিকে এক সার্বিক বীরভূমচিত্রের পরিচয় পেয়ে যাই দুই মলাটে।
দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত তৃতীয় অধ্যায়ে বীরভূমের রাজস্ব, অষ্টম অধ্যায়ে সেরউইলের রেভিনিউ সার্ভে এবং নবম অধ্যায়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং তৎসংক্রান্ত কবিতা ও সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই তিনটি অধ্যায়েই পাঠক গৌরীহরের ইতিহাসবোধের সম্যক পরিচিতি পাবেন। নিরপেক্ষ ভাবে এই বিবরণ উপস্থিত করলেও সাঁওতালদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি লক্ষণীয়। প্রত্যক্ষদর্শীর কিছু সাক্ষ্য উপস্থিত করে গৌরীহর রেখে গিয়েছেন এক অমূল্য উপাদান। তৃতীয় খণ্ডের ‘সমাজ’ অংশটি এই জেলার ইতিহাস রচনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সে কালে সামাজিক ইতিহাস চর্চার কোনও ধারা গড়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ ঘরের পাশে হাড়ি-ডোম-কৈবর্ত-বাগদিদের সম্পূর্ণ পরিচয় জানার আহ্বান জানিয়েছিলেন (ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ)। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ) লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলার সমাজ বিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস।’ গৌরীহর ১৩৪৩-এই ক্ষুদ্রাকারে হলেও উভয়ের ইচ্ছা ও বক্তব্যের প্রারম্ভিক ভূমিকা রচনা করেছিলেন। উপরন্তু নিজ জেলার ইতিহাস রচনাকালে তিনি তাকে যেমন অযথা গৌরবান্বিত করতে চাননি, অন্য দিকে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে জাতীয় ইতিহাসের ভণিতাও করেননি। শুধু যুগ বিভাজনের ক্ষেত্রে (হিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশ) সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস রচনার ধারায় প্রভাবিত হন তিনি। তবে একথাও স্বীকার্য, গৌরীহরের ইতিহাসলিখনে বিশ্লেষণ অপেক্ষা তথ্য-ভিত্তিক বিবরণের প্রাধান্যই বেশি।
পদ্ধতিগত দিক থেকে পার্থশঙ্খ মজুমদার সম্পাদিত এই গ্রন্থটি এক জন ইতিহাসমনস্ক লেখকের পরিচয় বহন করে। তিনি যে শুধু গৌরীহরের অগ্রন্থিত প্রবন্ধগুলিকে বইটির তৃতীয় খণ্ডে কালানুক্রমিক হিসেবে সাজিয়েছেন তা-ই নয়, একটি নির্ঘণ্ট বা নির্দেশিকাও দিয়েছেন। পরিশিষ্ট অংশে গৌরীহর সম্পর্কে তাঁর একটি নির্মোহ আলোচনাও উল্লেখযোগ্য। তৎকালেই দুটি খণ্ডের বিভিন্ন সমালোচনা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে যদুনাথ সরকার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, নির্মলকুমার বসু— কে নেই সেই তালিকায়! উপরন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সমালোচনা তো আছেই। সম্পাদক এগুলি দিয়ে পাঠককে নিরপেক্ষ মতামত গঠনের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় পাদটীকা যোগ করায় সম্পাদনার গুণগত মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রণ পারিপাট্যের জন্য ‘আশাদীপ’কে ধন্যবাদ। ইতিহাস-উৎসাহী ও সাধারণ উভয় পাঠকই যে এই বইটি থেকে তাঁদের ভিন্ন মাত্রিক ইতিহাস-ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম হবেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.