|
|
|
|
মৌসম ভবনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন |
বর্ষা গণনায় তাড়া করে যাচ্ছে সেই ভ্রান্তির ভূত |
দেবদূত ঘোষঠাকুর • কলকাতা |
স্বাভাবিক বর্ষার পূর্বাভাস ছিল। অথচ সেপ্টেম্বর ফুরোতেই দেখা গেল, দেশের বেশ কিছু অঞ্চল খরার কবলে! ২০০৯ সালে দিল্লির মৌসম ভবনের বর্ষা-পূর্বাভাসের এ হেন পরিণতি আবহবিদদেরা যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল।
এবং এ বারও স্বাভাবিক বর্ষার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। কিন্তু জুন মাসে সারা দেশে বৃষ্টির হা দেখে ২০০৯-এর ভূত তাড়া করে বেড়াচ্ছে আবহবিদদের একাংশকে। সে বছরও জুনে দেশ জুড়ে বৃষ্টি-পরিস্থিতি ছিল এ বারের মতো। কিন্তু মৌসম ভবন বলেছিল, জুলাই-অগস্টে পর্যাপ্ত বৃষ্টি ঘাটতি মিটিয়ে দেবে। দেয়নি। সেই আশ্বাসবাণীর পুনরাবৃত্তি শুক্রবারও শোনা গিয়েছে।
২০০২ সালের ছবিটাও ছিল একই রকম। বর্ষা নামার আগে মৌসম ভবনের পূর্বাভাস ছিল, ১০৮% বৃষ্টি হবে। হয়েছিল ৮১%, অর্থাৎ ২৭% কম। তীব্র খরার মুখে পড়েছিল গোটা দেশ। আবার ১৯৯৪-এ ৯২% বৃষ্টির পূর্বাভাস কার্যক্ষেত্রে দাঁড়ায় ১১০ শতাংশে। ২০০৭-এও পূর্বাভাসের ১৩% বাড়তি বৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুত মৌসম ভবনের তথ্যই বলছে, ১৯৯৪ থেকে ২০১১ এই ১৮ বছরে বর্ষা নিয়ে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস মেলেনি অন্তত ১২ বার। তার মধ্যে ৮ বারই বৃষ্টি হয়েছে পূর্বাভাসের কম। ভুগেছেন কৃষকেরা, ভুগেছে দেশের অর্থনীতি। তবে বাড়তি বৃষ্টির ক্ষেত্রে চাষিদের লাভ হয়েছে বলে আবহবিদদের দাবি। ২০১২-র পরিস্থিতি কী?
চলতি বছরে সারা দেশে ৯৬% থেকে ১০৪% বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে মৌসম ভবন। এ দিকে জুনের গড় অনুযায়ী, বৃষ্টির ঘাটতি ২৩%। দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু রাজ্য, হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে অতিবৃষ্টি না-হলে পরিমাণটা আরও কমতো। জুনের শেষেও বিহার-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশে তাপপ্রবাহ বয়েছে। উত্তর-পশ্চিমে কোথাও কোথাও ঘাটতি পৌঁছে তো ৯৬% ছুঁয়েছে! দিল্লিতে ৭৬%।
অর্থাৎ, জুনের বৃষ্টির নিরিখে এ বার বর্ষার বৃষ্টিপাত কিন্তু পূর্বাভাসের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, গত ২২ জুন মৌসম ভবনের দেওয়া পূর্বাভাস মিলবে তো? |
|
মৌসম ভবনের পূর্বাভাসে ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাত বলতে বোঝায় ১৯৫১ থেকে ২০০০ এই পঞ্চাশ বছরে জুন-সেপ্টেম্বর চার মাসে দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এর ৫% বেশি-কম হলেও তা স্বাভাবিক ধরা হয়। মৌসম ভবন সাধারণত দু’বার বর্ষার পূর্বাভাস দেয় এপ্রিলে আর জুনে। কিন্তু এখন তাদের পূর্বাভাসের পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন কৃষি-বিশেষজ্ঞদের অনেকে। যাঁদের মতে, বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ায় বর্ষা-পূর্বাভাস দিয়ে বার বার ঠকে যাচ্ছেন আবহবিদদেরা। আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে গবেষণারত কারও কারও অভিযোগ, বর্ষা যে তার নির্ঘণ্ট থেকে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে, মৌসম ভবন তা মানতে চাইছে না। ওঁদের দাবি, দেশের কোথাও (বিশেষত পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে) বর্ষার মেয়াদ অক্টোবরের শেষে গিয়ে ঠেকায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসেব কষলে গণনায় ভুল হতে বাধ্য। এক গবেষকের কথায়, “পূর্ব ভারতে জুনের বৃষ্টি কমেছে। গোটা দেশে জুলাইয়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ার কথা, অথচ গত দশ-পনেরো বছর ধরে সর্বাধিক বৃষ্টি হচ্ছে অগস্টে। আবার সেপ্টেম্বরে বর্ষণের পরিমাণ স্বাভাবিকের অনেকটা বেশি।”
অন্য দিকে মৌসম ভবনের দাবি, তাদের পূর্বাভাসের পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত। এক আবহবিজ্ঞানী জানান, বছরের বিভিন্ন সময়ে আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুর চাপের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়ের নিরিখে তাঁরা পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। “দেশ-বিদেশের ১৩টি প্রতিষ্ঠানের আবহবিজ্ঞানী-গবেষকদের সমীক্ষার ভিত্তিতে ওই সব তথ্য জোগাড় হয়। তবে তাপমাত্রা বা বায়ুর চাপ সবর্দাই বদলাচ্ছে। তাই কখন-কখনও পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবের কিছুটা ফারাক থাকা অস্বাভাবিক নয়।” মন্তব্য তাঁর।
এ বার উত্তর-পূর্ব ভারতেও (পশ্চিমবঙ্গ যার মধ্যে) স্বাভাবিক (৯৫%) বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে মৌসম ভবন। কিন্তু জুনের হিসেবের নিরিখে ওই ভবিষ্যদ্বাণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কৃষি-বিশেষজ্ঞেরা রীতিমতো চিন্তিত। জুনে গোটা উত্তর-পূর্বে গড়ে ৪% বাড়তি বৃষ্টি হয়েছে। অসম-উত্তরবঙ্গের একাংশে অতিবৃষ্টির হার ৭০%, যার জেরে বন্যা হয়েছে। অথচ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ঘাটতি ৪০%! জুনে তো দক্ষিণবঙ্গের বেশ ক’টা জেলায় অনাবৃষ্টির পরিস্থিতি ছিল। জুলাইয়ে কী হবে?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরে একটা ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে। তার প্রভাবে শুক্রবার থেকে দক্ষিণবঙ্গের আকাশে মেঘ ঢুকতে শুরু করেছে। তবে ঘূর্ণাবর্তটি বৃষ্টির অনুকূল হতে আরও দিন সাতেক লাগতে পারে। অর্থাৎ, আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি নাগাদ দক্ষিণবঙ্গে ফের বৃষ্টির আশা করছেন আবহবিদেরা।
আর জুলাইয়ের শুরুটা ভাল হলে বর্ষা ফের নিজের ছন্দে ফিরতে পারবে বলেও তাঁরা আশাবাদী। |
|
|
|
|
|