|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
তত্ত্বমসি |
তপন বন্দ্যোপাধ্যায় |
অমানিশার ঘন যামিনীর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তার পর্ণকুটির আবৃত, বিভাবরীর সেই নিষুপ্তি মুহূর্তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রতীক্ষা করছে কৃষ্ণপ্রিয়া। আজ তার কুটিরে এমন এক জন অতিথির পদার্পণ ঘটবে, যার কথা সে কোনও দিন স্বপ্নেও অনুমান করেনি। সেই অতিথির কঠোর নির্দেশ, তার আগমনের কথা যেন কুটিরের চার দেওয়াল ব্যতীত অন্য কেউই অবগত না হতে পারে। সেই অতিথি বার্তা প্রেরণ করেছেন তাঁর আগমনের সময় মধ্যরাত্রি অতীত হলে, যখন অবশিষ্ট বিদেহরাজ্য থাকবে ঘোর নিদ্রার গভীরে। সেই অতিথি তাঁর প্রিয় অশ্বপৃষ্ঠেও আসবেন না, তাঁর উপস্থিতি ঘটবে পদব্রজে, তাঁর মুখাবয়ব থাকবে একখণ্ড বস্ত্রে আবৃত। তাঁর সঙ্গে থাকবে মাত্র এক জন সশস্ত্র রক্ষী, এমনও হতে পারে সেই রক্ষী যাতে বিষয়টি পঞ্চজনকে বিবৃত করতে না পারে, তাকে অবশিষ্ট জীবন কালাতিপাত করতে হবে কোনও গবাক্ষহীন প্রোকোষ্ঠের অন্ধকার পরিবেশে।
এ সমস্তই পরিজ্ঞাত কৃষ্ণপ্রিয়ার, তবে সে এ তথ্য অবহিত নয় যে আজ রাত্রিকালের পর তাকেও অতিবাহিত করতে হবে কি না এ রকম কোনও তমিস্রালিপ্ত পর্ণগৃহের অন্তরালে!
কিন্তু সেই ভবিতব্যের কথা এই মুহূর্তে মস্তিষ্কের অন্তরালে প্রেরণ করে কৃষ্ণপ্রিয়া অধীর অপেক্ষায় দৃষ্টি ন্যস্ত করে সম্মুখস্থ পথের দিকে। বিষয়টি গোপন রাখার অভিপ্রায়ে তাকে আজ বিদায় করতে হয়েছে তার কুটিরের পরিচারিকা চম্বা ও তার প্রিয়সখী রত্নাবলীকেও। কৃষ্ণপ্রিয়া এই কুটিরে আজ একান্তই একা। তার এই একক উপস্থিতির মুহূর্তে এসে পৌঁছবেন—
না, কোনও ক্রমেই প্রকাশ করা যাবে না সেই পুরুষের বারযোষিৎ গৃহে রাত্রিযাপনের কথা। এমনকী কৃষ্ণপ্রিয়াকে বিস্মৃত হতে হবে তাঁকে যথার্থ পরিচয়ে সম্বোধনের কথাও।
এই শেষ বাক্যটি অনুসরণ করা কৃষ্ণপ্রিয়ার কাছে সর্বাপেক্ষা কঠিন।
কৃষ্ণপ্রিয়ার চেতনা তখন স্মরণ করতে চাইছে এই সেই পুরুষ, যিনি কিয়ৎ বৎসর পূর্বে ঘোষণা করেছিলেন এক অভিনব নির্দেশ। অবশ্য তাঁর কণ্ঠে ছিল নির্দেশিকা নয়, অনুরোধের স্বর। তিনি জানিয়েছিলেন বিদেহ রাজ্যে অসংখ্য অভিজাত শ্রেণির বাস, কিন্তু পৃথিবীর যে কোনও জনপদের ঐতিহ্য অনুসারে বিদেহ রাজ্যেও সৃষ্টি হয়েছে এক গণিকালয়ের। জৈবিক কারণে এই সৃষ্টি স্বাভাবিক, কেননা, পুরুষ প্রকৃতিগত ভাবে বহুগামী, বহু পুরুষ এক নারীতে তৃপ্ত হয় না, তাই বিদেহের বহু উচ্চবংশীয় ব্যক্তি গমনাগমন করে অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর বারাঙ্গনা গৃহে, তাদের সঙ্গে উপগত হয় ও এই সময়কালে যে কথোপকথনে রত হয়, তা স্বাভাবিক ভাবেই নিম্ন শ্রেণির, এমনকী কখনও পরিপাক করে সেই বারগণিকাদের অশ্লীল বাক্যও। এমনকী বিদেহের কোনও কোনও বেদজ্ঞ পুরুষও কখনও তাদের কামনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে গমন করে উক্ত গণিকালয়ে। এই কর্ম একান্তই অসমর্থনীয়। বিষয়টি অতি গর্হিতও। সমাজের এই ব্যবস্থার পরিবর্তনকল্পে প্রয়োজন এক বিকল্প ব্যবস্থা। আমার অভিলাষ বিদেহ রাজ্যে থাকবে এক জন বারযোষিৎ। সে হবে এমন এক নারী, যে একাধারে শিক্ষিত হবে, এমনকী বেদচর্চাও থাকবে তার আয়ত্তে, এবং সে নির্দিষ্ট থাকবে শুধুমাত্র উচ্চবংশীয় মানুষদের কামনা চরিতার্থ করতে। এমনকী কোনও বেদজ্ঞ মানুষের সঙ্গে উপগত হতেও দ্বিধা বোধ করবে না। |
 |
রাজা অতঃপর উচ্চারণ করেছিলেন এক দুঃসাহসী অনুরোধ। বলেছিলেন যদি বিদেহে এমন কোনও নারী স্বেচ্ছায় এই জীবন বরণ করতে অভিলাষী থাকে তার আশ্রয় ও যাবতীয় প্রতিপালনের দায়িত্ব আমার। সে-ই হবে বিদেহের একমাত্র বারযোষিৎ।
‘যোষিৎ’ শব্দটির উপর তিনি আরোপ করেছিলেন এক অন্য স্বর, যাতে সেই নারীর গুরুত্ব বিষয়ে অবহিত হয় রাজ্যবাসী।
তাঁর সেই ঘোষণায় প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল বিদেহবাসীদের মধ্যে।
কিন্তু তার চেয়েও প্রতিবাদ আবর্তিত হয়েছিল যখন সত্যই এক নারী রাজার ঘোষণাকে মর্যাদা দিতে সমর্পণ করেছিল নিজেকে। চতুর্দিকে নানা জল্পনার মধ্যে অকস্মাৎ কৃষ্ণপ্রিয়াই সমস্ত বিদেহকে চমকিত করে উপস্থিত হয়েছিল রাজার সমীপে, বলেছিল, রাজন, আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত।
রাজা অবশ্য চমকিত হয়েছিলেন কৃষ্ণপ্রিয়ার অনন্যসাধারণ রূপ ও পরিপূর্ণ যৌবন প্রত্যক্ষ করে। এই নারী হবে বারযোষিৎ! এই নারী তো অপ্সরার চেয়েও রূপসী! বিভ্রান্ত স্বরে বলেছিলেন, তুমি!
—হ্যাঁ, রাজন, আমার এই শরীর যদি বিদেহের কোনও উপকারে লাগে, তবে এই সামান্য নারীজীবন কৃতার্থ হবে।
রাজা নিজেও বিস্মিত, বলেছিলেন, পরে তোমার কোনও অনুশোচনা হবে না তো!
—না, রাজন, আমি বহু চিন্তনের পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
—কৃষ্ণপ্রিয়া, তুমি অপরূপা সুন্দরী, তুমি বিবাহযোগ্যাও হয়েছ, এ বিষয়ে তুমি দ্বিতীয় চিন্তন করো।
—না, রাজন, আমি আগেই বলেছি, শুধু দ্বিতীয় চিন্তন নয়, বহু আলোচনা, পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমি অবহিত আছি অহং সঃ, আমার ভিতরে অবস্থান করছেন একতিল ঈশ্বর, আর যিনি আমার কুটিরে আসবেন তাঁর ভিতরেও অবস্থান করছেন সেই তিনি।
রাজার সেই উচ্চারণে যত না বিক্ষোভের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়েও প্রতিকূলতার আবহাওয়া ত্বরান্বিত হয়েছিল কৃষ্ণপ্রিয়ার এই স্বেচ্ছাচারে। কিন্তু রাজা অতঃপর সমস্ত প্রতিপক্ষকে উপেক্ষা করে কৃষ্ণপ্রিয়াকে আহ্বান করে বলেছিলেন, যথার্থই বলেছ, কৃষ্ণপ্রিয়া, তৎ ত্বম্ অসি। তুমিই তিনি। আমি অবহিত হয়েছি তুমি উপযুক্ত গুরুর নিকট যথেষ্ট শিক্ষাগ্রহণ করেছ, এমনকী বেদচর্চাও করেছ, সেই কারণেই তুমিই এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত। তুমি সর্বদা স্মরণে রাখবে তুমি হবে সেই নারী, যার কুটিরে অভিজাত বংশীয় কোনও পুরুষের আগমন ঘটলে তার সঙ্গে আলোচনা হবে রুচিসম্মত। তোমার কুটিরে হয়তো বা পদার্পণ করবেন কোনও বেদজ্ঞ পুরুষও, সেই সময় কালে তুমি তাঁদের সঙ্গে যে কথোপকথন করবে, তা হবে এক উচ্চমার্গের আলোচনা। তবে—
|

|
রাজা পুনর্বার উচ্চারণ করেছিলেন, তবে একটাই শর্ত, তোমার নিকট যত পুরুষের আগমন ঘটবে, তাদের মধ্য থেকে উপযুক্ত পুরুষ নির্বাচন করার অধিকার তোমার থাকবে।
কৃষ্ণপ্রিয়া নতমস্তকে সম্মত হয়েছিল রাজার প্রতি উচ্চারণে।
অতঃপর রাজাদেশে কৃষ্ণপ্রিয়া শুরু করেছিল সেই অন্য জীবন।
তার পর সে অতিক্রম করেছে কিয়ৎ বৎসর, তার রূপযৌবন আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে এই সময় কালে, তার মেধা হয়েছে আরও শাণিত, তার কথা হয়েছে আরও বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু সে কখনও অনুমান করেনি সেই রাজা স্বয়ং পদার্পণ করবেন তার পর্ণকুটিরে!
রাত্রি তখন মধ্যযাম অতিক্রম করে তৃতীয় প্রহরের দিকে ধাবমান, সেই অসীম তমসার মুহূর্তে কৃষ্ণপ্রিয়ার দৃষ্টিগোচর হয় এক বিশালদেহী পুরুষ অতি সন্তর্পণে পদব্রজে আগমন করছেন তার পর্ণকুটিরের উদ্দেশে। তার অব্যবহিত পশ্চাতে আর এক পুরুষ শরীর, নিশ্চিত সে তাঁর দেহরক্ষী। সেই বলশালী পুরুষ ধীর পদে তার নিকটে এসে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, তা হলে পথভ্রষ্ট হইনি!
কৃষ্ণপ্রিয়া মধুর হাস্য বিচ্ছুরিত করে বলল, আপনি যথার্থ গন্তব্যেই উপস্থিত হয়েছেন।
সেই পুরুষ অতঃপর তাঁর রক্ষীর উদ্দেশে ইঙ্গিত করলেন কুটিরের অঙ্গনপ্রান্তে অপেক্ষা করতে, সে সেই স্থানে স্থানু হয়ে যেতেই তিনি কৃষ্ণপ্রিয়াকে অনুসরণ করে প্রবেশ করলেন কুটিরের অভ্যন্তরে।
কুটিরের অন্তর্ভাগে নিবিড় তমসা, তাঁর নির্দেশ মতো কৃষ্ণপ্রিয়ার কক্ষে একটি দীপশিখাও প্রজ্জ্বলিত হয়নি। প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কৃষ্ণপ্রিয়ার দীর্ঘ তন্বী শরীরও তেমন দৃশ্যমান নয়, সেই পুরুষ তখন তাকে নিম্ন স্বরে বলছেন, কৃষ্ণপ্রিয়া, আমি কখনও অনুধ্যান করিনি তোমার গৃহে কোনও এক দিন উপনীত হতে হবে আমাকে!
কৃষ্ণপ্রিয়ার হৃৎপিণ্ডে তখন ধ্বনিত হচ্ছে বজ্রের নিনাদ, সে তীব্র অন্ধকার ভেদ করে চাক্ষুষ করতে চাইছে সেই পুরুষকে, নিরীক্ষণ করতে চাইছে তাঁর প্রগাঢ় উপস্থিতি। তার কণ্ঠে মৃদু ঝংকার ধ্বনি, আপনার এ রকম অভিপ্রায় হওয়া কোনও ব্যতিক্রম নয়। আপনি এক জন পুরুষ। পুরুষের তো প্রয়োজন হতে পারে এক জন নারীকে।
—কিন্তু আমি আমার রাজধর্ম বিসর্জন দিয়ে তোমার সমীপে এসেছি তা তো কাঙ্ক্ষণীয় নয়, কৃষ্ণপ্রিয়া!
—কিন্তু পুরুষধর্ম পালন করাও তো আপনার পক্ষে সমীচীন।
রাজা কিয়দ্দণ্ড নীরব, নির্বাক। |
 |
কৃষ্ণপ্রিয়া তখন প্রস্তুত হচ্ছে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য, অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করল, হে পুরুষ, আমার কুটিরের দীপাধারগুলি আজ সবই নির্বাপিত। এই প্রবল অন্ধকারে আপনি কি প্রত্যক্ষ করতে পারছেন আমার শরীর!
—পারছি, কৃষ্ণপ্রিয়া। তুমি হয়তো জানো না আমার প্রত্যেক ইন্দ্রিয় অন্য সকলের চেয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। আমার দুই চক্ষু তীব্র নিশার মধ্যেও স্পষ্ট লক্ষ করতে পারে লক্ষ্য। আমি এই মুহূর্তে বর্ণনা করতে পারি তোমার পরিধানে কী পোশাক!
কৃষ্ণপ্রিয়া বিস্মিত হয় না, আবার হয়ও। সে নিজেই চাক্ষুষ করতে পারছে না কী কী বস্ত্র আছে তার পরিধানে! এই পুরুষকে জিজ্ঞেস করা তার পক্ষে সমীচীন নয়, তবু কী এক অসমসাহসে সে প্রশ্ন করল, বলুন তো কী পোশাক আমার অঙ্গে?
সেই পুরুষ মৃদু হাস্য করলেন কৃষ্ণপ্রিয়ার প্রশ্নে, বললেন, তুমি পরিধান করেছ একটি পিঙ্গল বর্ণের বল্কল, সেই রং এমনই ঘন যে, বিদেহের পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের কিয়ৎ পরে শুভ্র মেঘের গায়ে যে রং ধারণ করে তেমনই।
কৃষ্ণপ্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে বলল, যথার্থই বলেছেন।
—তোমার ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি পীতবর্ণের কঞ্চুকী, তার উপর স্বচ্ছ রক্তবর্ণের নিবীত, যা ভেদ করে তোমার স্ফীত স্তনবৃন্ত পর্যন্ত দৃশ্যমান।
কৃষ্ণপ্রিয়া বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে বলল, কী আশ্চর্য দৃষ্টিশক্তি আপনার!
কৃষ্ণপ্রিয়া, তোমার দুই ওষ্ঠে রক্তবর্ণের ওষ্ঠরঞ্জনী, তোমার দুই কর্ণে কর্ণমালা, তোমার বাহুতে বাজুবন্ধ, তোমার দুই মণিবন্ধে বলয়, তোমার কণ্ঠে কণ্ঠহার, তোমার নাসিকায় নাসিকালোল, তোমার ললাটে ললাটভূষণ, তোমার কটিতে কিঙ্কিণী।
আশ্চর্য দৃষ্টিশক্তি আপনার!
—কৃষ্ণপ্রিয়া, তোমাকে আমি আমার গৃহে বহু বার উপস্থিত হতে দেখেছি, তোমার দিকে দৃকপাত করাও আমার কাছে অধর্ম, তাই সর্বসমক্ষে তোমার রূপ আমি অবলোকন করেছি তিলমাত্র ক্ষণের জন্য, সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে তোমার অসামান্য রূপ, তোমার শারীরিক গঠন ও সৌন্দর্য।
—আমি সত্যই আজ ধন্য।
—কিন্তু কৃষ্ণপ্রিয়া, আমি বহু দিন ধরে একান্ত ভাবনায় আবিষ্কার করতে চেয়েছি কী সেই কারণ, যার জন্য তোমার প্রতি আকৃষ্ট বোধ করে সমস্ত মানুষ। তোমাকে তারা লাভ করতে অসমর্থ, কিন্তু মনে মনে কামনা করে!
কৃষ্ণপ্রিয়া তখন প্রস্তুত হচ্ছে তার নারীধর্ম পালনের জন্য। সে ক্রমে নিজেকে অবারিত করতে শুরু করে, প্রথমেই উন্মুক্ত করে তার ঘন কৃষ্ণবর্ণ কেশরাজি, তার অঙ্গুলির সামান্য ঘূর্ণনে স্খলিত হয় কবরীবন্ধন, মুহূর্তে তরঙ্গায়িত হয়ে সেই অলকরাশির অবতরণ করে স্কন্ধ থেকে পৃষ্ঠদেশে, সেখান থেকে স্ফীত নিতম্বের উপর। সেই আজানুলম্বিত আলুলায়িত কুন্তল আরও মোহময়ী করে তোলে কৃষ্ণপ্রিয়াকে। অতঃপর উন্মুক্ত করতে শুরু করল তার অঙ্গের সমস্ত অলংকার, অপসারিত হল তার ললাটভূষণ, কটিতট থেকে কাঞ্চি, পদযুগল থেকে পাদঙ্গদ, কর্ণাবতংস...
অতঃপর ক্রমান্বয়ে স্খলন করতে শুরু করল তার পরিধানের যাবতীয় বসন, মুহূর্তে উড্ডীয়মান হল রক্তরং নিবীত, সবেগে উন্মোচিত হল তার উষ্ণ কঞ্চুকী, নিপুণ তৎপরতায় উন্মুক্ত হল তার মোহময় বল্কল। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কিয়ৎকাল এক অনিবার্য প্রতীক্ষায় দণ্ডায়মান থেকে কৃষ্ণপ্রিয়া অস্ফুট কণ্ঠে বলল, আপনি কি আমাকে চাক্ষুষ করতে পারছেন?
—পারছি, কৃষ্ণপ্রিয়া। নিবিড় তমিস্রার মধ্যে তোমার নিরাবরণ শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক আশ্চর্য বিভা।
কৃষ্ণপ্রিয়ার শরীরে তখন শুরু হয়েছে এক অনিবার্য কম্পন, সে অপেক্ষা করছে সেই পুরুষের নিবিড় আশ্লেষের, তার অঙ্গসঙ্গের।
কিন্তু সেই পুরুষ তখনও একদৃষ্টে অবলোকন করছেন তার বিবসনা শরীর।
—হে পুরুষ, আমি প্রস্তুত, কৃষ্ণপ্রিয়ার সম্ভোগপূর্ব কণ্ঠে ঈপ্সিত, অস্পষ্ট উচ্চারণ।
পুরুষ তখনও তাঁর দৃষ্টি অপসারণ করেননি কৃষ্ণপ্রিয়ার মিলেনোন্মুখ শরীর থেকে। কিন্তু তিনি নিশ্চেষ্ট, তিনি নিস্পৃহ, তিনি উদাসীন।
কৃষ্ণপ্রিয়া অস্থির হয়ে ওঠে, তার শরীরের অভ্যন্তরে জাগরূক হয় এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যার ফলে সে পুনর্বার উচ্চারণ করে হে পুরুষ, আমার উন্মুখ অধরোষ্ঠে সঞ্চিত হয়েছে স্বর্গসুধা, আপনি সেই অমৃত পান করুন
আরও উৎসুক প্রতীক্ষার পর নির্লিপ্ত পুরুষ তাঁর চক্ষু সেই নিহঙ্গ শরীর থেকে অপসারিত হয়ে ন্যস্ত হল বহির্জগতের ঘন তমসার দিকে, কিয়ৎ পরে বললেন, কৃষ্ণপ্রিয়া, আমি কিন্তু তোমার কুটিরে সম্ভোগের জন্য আসিনি।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে কৃষ্ণপ্রিয়া জিজ্ঞাসা করল, তা হলে?
—কৃষ্ণপ্রিয়া, তুমি নিশ্চয় অবহিত আছ আমার প্রাসাদে বহু স্ত্রী বর্তমান, আমি বহু নারী সংসর্গ করেছি, অভিলাষ হলে যে কোনও দিন আরও বহু নারীর পাণিগ্রহণ করতে পারি, কিন্তু যোষিৎসংসর্গ আজ আমার উদ্দেশ্য ছিল না—
কৃষ্ণপ্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে দৃষ্টি ন্যস্ত করেছে সেই পুরুষের অন্ধকারবৃত মুখমণ্ডলের উপর, আবারও অস্ফুট কণ্ঠে বলল, তা হলে কী উদ্দেশ্যে?
—আমার সংযম পরীক্ষা করাই ছিল আজকের উদ্দেশ্যে। তুমি এই নগরীর বারযোষিৎ। কিয়দ্দিন পূর্বে কোনও এক বেদজ্ঞ পুরুষ তোমার কুটিরে এসে তোমার সঙ্গে যাপন করেছিল রাত্রি, তারই মুখে শ্রুত হয়েছিলাম মধ্যরাত্রিতে তোমার কণ্ঠস্বরে যে ঝংকার উৎসারিত হয় তার আকর্ষণ দুর্দম, বল্কল পরিহিত তোমার যে উপস্থিতি তার মোহ দুর্নিবার, তোমার নিরাবরণ শরীরের আকর্ষণ আরও অপ্রতিরোধ্য। তুমি নিশ্চয় অবহিত আছ আমার জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে বেদ-বেদাঙ্গের নিরন্তর চর্চায়, সেই আমি এই ষষ্টি বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি সন্ন্যাস গ্রহণ করব। কিন্তু তার পূর্বে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম আমার জাগতিক কামনা-বাসনা সব উপেক্ষা করতে সমর্থ হয়েছি কি না! কৃষ্ণপ্রিয়া, আজ রাত ছিল আমার সেই নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করার সময়। আমি নিজের চরিত্র পর্যালোচনা করে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম বিদেহের শ্রেষ্ঠ বারযোষিতের আকর্ষণ আমি উপেক্ষা করতে পারি কি না!
তিনি অতঃপর যতি দিলেন তাঁর উচ্চারণ, তার পর বললেন, কৃষ্ণপ্রিয়া আমি সমর্থ হয়েছি। উপলব্ধি করেছি তত্ত্বমসি, তুমিই তিনি—
সেই পুরুষ আর তিলমাত্র অপেক্ষা করলেন না সেই অনাবৃত নারীর সম্মুখে, তখন শেষ রাত্রি, অন্ধকার ক্রমশ বিলীয়মান সেই নির্জন প্রেক্ষাপটে, সেই পটভূমি অতিক্রম করে তিনি যে রকম সন্তর্পণে আগমন করেছিলেন কৃষ্ণপ্রিয়ার পর্ণকুটিরে, তেমনই সতর্ক পদক্ষেপে প্রত্যাগমন করলেন তাঁর গন্তব্যে।
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
 |
|
|