|
|
|
|
|
|
|
চল রাস্তায় সাজি সাইকেল |
আমস্টারডাম, প্যারিস, বেজিংয়ের পর কলকাতার নামও উচ্চারিত হোক সাইকেলের
ক্রিং ক্রিং ধ্বনিতে। আর একটু বাসযোগ্য একটা শহরের স্বপ্ন দেখেছেন মোহিত রায়
|
|
ছবি-১ |
দিল্লির একশো ফ্লাইওভারের উপর বসেছে সান্ধ্য আড্ডা। গ্রীষ্মের সন্ধেয় হাল্কা আলো, হাওয়ায় এখনও বসন্তের ছোঁয়া, ছোটাছুটি করছে শিশুরা, বড়রা পরচর্চা, গল্পগুজব। বিক্রি হচ্ছে আইসক্রিম, ভেলপুরি। দিল্লিতে পার্ক কম নেই, কিন্তু এ রকম উড়াল পার্ক একেবারে নতুন চমক। টবে আর কিছু মাটি ফেলে গাছ লাগিয়ে ফ্লাইওভার হয়ে উঠেছে ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান। দিল্লিতে মেট্রো রেলের জাল ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সব দিকে। এক মিনিট অন্তর ট্রেন, লোকে এখন মেট্রো ছাড়া ভাবেই না। রাস্তায় অনেক বাস, আর বাসের জন্য বিশেষ পথের ব্যবস্থা করায় তা ছুটছে নির্বিবাদে। ব্যক্তিগত গাড়িতে কর ও তেলের দাম বেশ ক’গুণ বাড়িয়ে দেওয়ায় নিজের গাড়ি চালানো এখন বোকামো। রাস্তায় এখন সিঙ্গাপুরের মতন গাড়ি কম, ফলে সব ফ্লাইওভার বন্ধ করে তা হয়েছে পাড়ার আকাশ-বাগান।
|
ছবি-২ |
সাঁই সাঁই করে সাইকেলের মিছিল সকালে চলেছে কাজের জায়গায়। কলকাতায় বাইপাসে মাথার উপর মেট্রো, মাটিতে জনসাধারণের বাসের জন্য বিশেষ পথের দু’পাশে তৈরি হয়েছে আর একটি পথ, সাইকেলপথ। সে রাস্তার দু’পাশে গাছ লাগানো হয়েছে, তার ঠান্ডা ছায়ায় মহানগরী চলেছে সাইকেলের সওয়ার হয়ে। সাইকেলে অফিস যাওয়াটাই আই টি-র তরুণতরুণীদের স্টাইল এখন। কত রঙের, নকশার সাইকেল ছুটছে, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ টি-শার্ট, কামিজের চলন্ত রঙিন ঢেউ। শহরে সব মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে সাইকেল স্ট্যান্ড, সাইকেলে চেপে মেট্রো ধরাটাই স্টাইল। প্যারিস, বেজিংয়ের মতন এই সব স্ট্যান্ডে সাইকেল ভাড়াও পাওয়া যায়।
আশ্চর্য লাগছে? এমনটিই কিন্তু হওয়ার কথা। যদি আমাদের পরিকল্পনাকার আর প্রযুক্তিবিদরা সাধারণের কথা চিন্তায় রাখেন, দুনিয়ার খবর রাখেন আর পরিবেশের জন্য একটু সহানুভূতি দেখান, তবে এই ছবি আমরা সত্যি দেখতে পারি আগামী দিনগুলিতেই।
|
অর্বাচীন রাজপথ |
দেশে এখন সড়ক উন্নয়নের ধুম লেগেছে। ষাট হাজার কোটি টাকা খরচ করে দিল্লি-কলকাতা-চেন্নাই-মুম্বই স্বর্ণ চতুর্ভুজ জাতীয় সড়ক তৈরি মোটামুটি শেষ। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে প্রশস্ত থেকে আরও প্রশস্ত রাজপথ আর উড়াল পথের আস্ফালন। গত এক দশকে দিল্লি শহরে ছোট-বড় প্রায় একশো ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে মসৃণ যান চলাচলের জন্য। অন্য শহরগুলি এ বার রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শুরু করেছে।
‘রাজপথ’ কথাটা বেশ ভারিক্কি শোনালেও মানুষের ইতিহাসে এর গুরুত্ব বেশি দিনের নয়। পুরনো সব ঐতিহাসিক নগর রোম, কনস্টানটিনোপল, পিকিং, দিল্লির সীমানা মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই শেষ হয়ে যেত, কারণ শহরের সাধারণ নাগরিকদের কাজেকর্মে ঘোরাঘুরি সব পায়ে হেঁটেই করতে হত। রোজ হেঁটে কাজকর্ম করতে হলে তো আর বেশি দূরে যাতায়াত করা পোষায় না। রোমানরা সাম্রাজ্য চালাতে ইউরোপে হাজার বছর আগে রাজপথ নির্মাণ করেছিল, শের শাহের রাজপথ তৈরির গল্প আমাদের ইতিহাসের পাঠ্য, কিন্তু এ সবই প্রশাসনের জন্য, অনেক মানুষের যাতায়াত বা বাণিজ্যের জন্য নয়।
মানুষ বরং নামল জলে। নদীতে নৌকা বেয়ে, পরে সমুদ্রে পাল তুলে পণ্য নিয়ে বিশাল জলযান পাড়ি দিল সাগরে, মহাসাগরে। সভ্যতার ইতিহাস জলপথের ইতিহাস, জলযানের ইতিহাস। কোনও বাস স্ট্যান্ড নয়, সভ্যতার কাহিনি শুনতে কান পেতে থাকতে হবে বন্দরে বন্দরে সিন্ধু, টাইগ্রিস, নীল, গঙ্গার বন্দরে যে সভ্যতার যাত্রা শুরু, অনেক পরে ভেনিস, লন্ডন, মার্সেই, সাংহাই বন্দরে লেখা হয় তার শেষ পর্বের গাথা। |
|
আধুনিক সভ্যতা বিরাট লাফ দিয়ে এগোতে শুরু করল অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জোয়ারে। শুরু হল কলকারখানা আর ব্যবসাবাণিজ্যের বিস্তার। জলপথকে তাই নিয়ে যেতে হল দেশের অভ্যন্তরে, পণ্য পৌঁছনোর জন্য সারা দেশে নদী-নালা জুড়ে দিতে ইংল্যান্ডে কাটা হল অনেক খাল। এ দেশেও সাহেবরা কলকাতায় এসে আশপাশে কেটেছেন অনেক খাল। এ সব হতে হতে চলে এল বাষ্পীয় রেলগাড়ি। ১৮২৫ সালে প্রথম চলল রেলগাড়ি, শুরু হল আর এক বিপ্লব। এর আগে শ্রীচৈতন্য থেকে দেবেন্দ্রনাথ নদীপথেই যেতে হত পুরী কিংবা বারাণসী। ১৮৫৩ সালে ভারতে এসে গেল রেলগাড়ি আর ১৮৬৪-তে কলকাতা-দিল্লি রেলপথে যুক্ত হল, দেবেন্দ্রনাথ এ বার রবিকে ট্রেনেই ডালহৌসি পাহাড়ে নিয়ে যেতে পারবেন। এর এক বছর আগে, ১৮৬৩ সালে লন্ডনে চালু হয়ে গেল পাতাল রেল টিউব। কী অসম্ভব সাহসী চিন্তা! দেড়শো বছর আগে শহরের আমজনতার পরিবহণের জন্য রাস্তার ভিড় এড়িয়ে কয়লার ধোঁয়া ওড়ানো ট্রেন চলল মাটির নীচে সুড়ঙ্গ পথে। |
গরুর গাড়িতে ৭০০ কিমি |
লন্ডন, দিল্লি, কলকাতায় রাজপথে কিন্তু তখনও সেই ঘোড়ার গাড়ির দাপট। দূর দেশ যাত্রায় এ দেশে গরুর গাড়ির চলও কম ছিল না। বালক বিবেকানন্দকে নিয়ে তাঁর মা ভুবনেশ্বরী গরুর গাড়ি করে কলকাতা থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরের রায়পুর গিয়েছিলেন। ১৮৬৭ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে প্রথম আধুনিক বাইসাইকেল দেখা গেল। এবং কয়েক দশকের মধ্যেই সাইকেল ধনীর নতুন বিনোদন থেকে সাধারণ মানুষের যানে পরিবর্তিত হল। পৃথিবীর পথে দেখা গেল এক নতুন বাহন, যা এর পর গরিব বিশ্বের অপরিহার্য সামগ্রী হয়ে দাঁড়াবে। সাইকেল চালাতে লাগে মসৃণ পথ, ভাল রাস্তার দাবি তাই প্রথম উঠে আসে সাইকেল চালকদের থেকে। ইউরোপে তাঁরা নিজেরা চাঁদা তুলে রাস্তা ভাল করার কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে ১৮৮৯ সালে কলকাতায় আসে সাইকেল। ‘কুন্তলীন’ ও ‘দেলখোস’-এর আবিষ্কারক বিখ্যাত এইচ বসু (হেমেন্দ্রমোহন বসু) সাইকেলের দোকান খোলেন ও তিন স্যরকে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকারকে সাইকেল শেখান।
কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে? কয়েক দশক পরেই এসে গেল প্রতিদ্বন্দ্বী মোটরগাড়ি। ইউরোপে ১৮৮০ থেকে চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল পেট্রোল-চালিত অন্তর্দহন ইঞ্জিনের মোটরগাড়ি চালানোর। প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হল ১৮৮৮-তে। কলকাতাতে প্রথম মোটরগাড়ি আসে ১৮৯৬ সালে। ১৯০৮-এ আমেরিকায় হেনরি ফোর্ডের টি-মডেলের গাড়ি এনে দিল মোটরগাড়ির যুগ। যোগাযোগ থেকে ব্যবসাবাণিজ্য এ বার চলে এল স্থলপথে। এত দিনে রাস্তার কপাল খুলল। সারা আমেরিকা জুড়ে গেল হাইওয়েতে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ি আর রাজপথ, তেলের কোম্পানিরা হয়ে উঠল বিশ্ব অর্থনীতির নতুন ঈশ্বর। গাড়ির জন্য রাস্তা না রাস্তা মানে আরও গাড়ি, আরও গাড়ি মানে আরও তেল, আরও রাস্তা মাত্র একশো বছরে পৃথিবী জড়িয়ে পড়ল এক নতুন জালে। সাইকেল বেঁচে রইল গরিব পাড়ায়।
গাড়ি মানে দূষণ এ কথাটা সবাই জানেন। তবে সে কথায় যাওয়ার আগে এটাও বলে নেওয়া ভাল যে মোটরগাড়ি-শূন্য রাজপথ যে খুব একটা পরিবেশসম্মত ছিল, তা নয়। ১৮৮০ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে ছিল ১,২০,০০০ ঘোড়া। এদের রোজকার মলে রাস্তা স্থানে স্থানেই নোংরা হয়ে থাকত। এই মল ধোয়ার ফলে জলও ভয়ানক দূষিত হয়ে যেত। ওই বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তা থেকে সরাতে হয়েছিল ১৩০০০ মৃত ঘোড়া। ঘোড়াগাড়ি ও পথচারীর মধ্যে দুর্ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। লন্ডন শহরের এক বর্ণনায় পাচ্ছি যে পুরো রাস্তাটাই খানাখোন্দলে ভরা, দু’পাশের দোকানের ময়লা রাস্তাতেই ফেলা হচ্ছে, তার মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি গিয়ে তা আরও ছিটিয়ে দিচ্ছে পথচারীদের গায়ে। সারা পথ জুড়েই দুর্গন্ধ। মোটরগাড়ি এসে দূষণের রকমফেরটা পাল্টে গেল।
গত কয়েক দশকে পশ্চিম দুনিয়ায় গাড়ির প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে অনেক। গাড়িতে তেলের ব্যবহার কমেছে, কমেছে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাসে দূষকের পরিমাণ। ফলে পশ্চিমি শহরের হাওয়ায় এখন দূষণ বেশ কম, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কের মানুষেরা গত কয়েকশো বছরে এত ভাল হাওয়ায় নিশ্বাস নেননি। সত্যি কথা বলতে কী, ভারতের কোনও শহরের বাসিন্দা পশ্চিমি কোনও শহরের রাস্তায় সারা দিন দাঁড়িয়ে দূষণের কোনও ঠাহর পাবেন না, গাড়ির হর্নও শুনবেন না। এর মানে এই নয় যে, পশ্চিমি শহরে বায়ু দূষণ কমানোর আর প্রয়োজন নেই, কিন্তু প্রধান সমস্যাটা এখন তেলের ব্যবহার কমিয়ে, শহরের যানজট কমিয়ে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমানো। এ জন্য প্রয়োজন গাড়ির উপযুক্ত ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত গাড়ির কম ব্যবহার। পৃথিবীতে গাড়ির ব্যবহার কমানোই এখন সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নের নতুন লক্ষ্য।
পশ্চিমী দেশের কথা বলছি, কিন্তু তাক লাগানো কাজ করেছে দক্ষিণ-পূর্বের শহর সিঙ্গাপুর। জনপরিবহণ ব্যবস্থায় অসাধারণ উন্নতি করে আর ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়িতে কর বাড়িয়ে শহরে গাড়ির সংখ্যা চমকপ্রদ ভাবে কমিয়ে ফেলেছে। এর সঙ্গে রয়েছে শহরের বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ সময়ে গাড়ি নিয়ে গেলে বিশেষ কর দেওয়ার ব্যবস্থা। লন্ডনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বিশেষ সময়ে গাড়ি নিয়ে গেলে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। লন্ডন শহরেও বাস চলাচলের জন্য রাস্তার একাংশ ছেড়ে রাখা আছে, যেখানে অন্য গাড়ি চালানো বেআইনি। লন্ডনে মূল শহরে কোনও ফ্লাইওভার নেই, নেই প্যারিসেও। অনেক দিন আগে থেকেই গুরুত্ব দিয়ে মাটির নীচে রেল চালু করে তারা জনপরিবহণ সমস্যার অনেকটা সমাধান করেই রেখেছিল।
গত কয়েক দশকে যখন উন্নত দেশগুলি এ ভাবে ভাবছে, তখন ভারতের শিক্ষিত সুবিধাভোগী সমাজ ঠিক উল্টোটাই ভেবে চলেছে। এই সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হল রাজধানী দিল্লি। সেখানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ১৯৯৮-এর সাড়ে সাত লক্ষ থেকে বেড়ে ২০০৮-এ হয়েছে সাড়ে সতেরো লক্ষ। অথচ দিল্লির থেকে অনেক ধনী সিঙ্গাপুরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ২০১১-তে প্রায় ছ’লক্ষ। দেশের অন্য মহানগরীগুলিও রাস্তা আর ফ্লাইওভারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছে। এ দেশে এখন ব্যক্তিগত ডিজেল গাড়ির বিক্রি বেড়েছে হু হু করে।
বিভিন্ন মহানগরে মেট্রো রেল চালুর কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেগুলি আরও আগে না শুরু করার জন্য শহরে অহেতুক ফ্লাইওভার বা আরও রাস্তা বানিয়ে বা প্রশস্ত করে অযথা দেশের মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ বাস ও বাস চলার জন্য বিশেষ পথ এ সবও চালু করে রাজধানীর জনপরিবহণ অনেকটাই উন্নত হয়েছে। এ সব যখন হল তা হলে তার ক’দিন আগে এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার করার কী প্রয়োজন ছিল?
|
ক্রিং ক্রিং |
কলকাতার জল নিয়ে মোটাসোটা পরিকল্পনা রিপোর্টে যেমন লক্ষ লক্ষ লোকের রোজকার ব্যবহারের হাজার হাজার পুকুর কখনও স্থান পায় না, তেমনই কোনও শহরের পরিবহণ নিয়ে রিপোর্টে সাইকেলের কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায় না। কত লোক শহরে সাইকেল চালান, চালিয়ে কোথায় যান, কী তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা এ সব খবর কোথাও পাওয়া যায় না। কারণ একটাই, পরিকল্পনাবিদরা এ দেশে কখনও গরিব লোক ও লো-টেকনোলজির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। ঘামালে জানতেন যে, এ দেশে যখন গাড়ি নিয়ে মাতামাতি চলছে, উন্নত দেশে তখন সাইকেলে চড়ার উৎসাহ বাড়ছে হইহই করে। শিল্পোন্নত হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম এককথায় সাইকেল-শহর। লাখ দশেক মানুষের শহরে সাইকেল আছে সাড়ে ৫ লক্ষ। শহরের মূল অংশে গাড়ি খুব কম, অফিস-বাজার-কলেজ-স্কুল সবই যাওয়া হয় সাইকেল চড়ে। শহরের যত্রতত্র সাইকেল স্ট্যান্ডে রয়েছে শত শত সাইকেল।
২০০৭ সাল থেকে সাইকেল নিয়ে প্যারিসে শুরু হয়েছে এক দারুণ পরীক্ষা। সে শহরেও সাইকেল চলে খুব। শহরের রাস্তার চওড়া ফুটপাথের অনেকটা জুড়ে থাকে সাইকেলপথ, তাতে সাইকেলের ছবি আঁকা থাকে। এখন প্যারিসের ১২০০টি জায়গায় ১৮০০০ ভাড়ার সাইকেল রাখা রয়েছে। নাম নথিবদ্ধ করে যে কোনও ভাড়ার জায়গা থেকে সাইকেল ভাড়া করে অন্য যে কোনও ভাড়ার জায়গায় তা ফেরত দেওয়া যায়। ফেরত না দিলে ১৫০ ইউরো জরিমানা। প্রথম আধ ঘণ্টার জন্য কোনও ভাড়া লাগে না, পরে সময় বাড়লে ভাড়ার হার বাড়ে। প্যারিসে আইনি-বেআইনি অভিবাসীদের সংখ্যাধিক্যের জন্য অনেক সাইকেল চুরি হয়েছে, অকেজো করা হয়েছে। তবু সাইকেল ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা হারায়নি। বরং দেশের আরও ২৯টি শহরে এই ধরনের সাইকেল ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
কিন্তু সাইকেলের রাজধানী হল বেজিং। এক কালে পিকিং মানেই ছিল গাড়ি-শূন্য পথে শয়ে শয়ে সাইকেল। এখন বেজিংয়ে উন্নতির রমরমা, রাস্তায় চোখ ঝলসানো গাড়ি, তবু সাইকেলও কম নয়। বেজিংয়ে এখনও আছে ৯০ লক্ষ সাইকেল, তবে সব আর ব্যবহার হয় না। সেখানেও সাইকেল চলার জন্য রাস্তায় বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থা আছে, কোথাও শুধু সাইকেলের জন্য স্বতন্ত্র পথ, কোথাও রাজপথের একাংশ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও বেজিংয়ের ৬০ শতাংশ লোক সাইকেল ব্যবহার করতেন, এখন সেটা নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নীচে। চিনা কর্তৃপক্ষ আবার বেজিংয়ে সাইকেল চালানো বাড়াতে প্যারিসের ধাঁচে ১০০০ সাইকেল স্টেশন তৈরি করবেন, যাতে ৫০,০০০ সাইকেল ভাড়া পাওয়া যাবে। আশা করা যায় যে ২০১৫ সালের মধ্যে সাইকেল ব্যবহার বেড়ে হবে ২৫ শতাংশ।
তা হলে কলকাতা কেন নয়? কেন নয় দিল্লি? এখনকার ঝকঝকে মডেলের গাড়ি-চালিয়েদের সরকারি কর্মচারী বাবারা ষাটের দশকে দিল্লিতে লোদি কলোনির কোয়ার্টার্স থেকে সাইকেল চালিয়ে সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েটে আপিস করতে যেতেন। এখনও এ দেশের নানা শহরে অনেক মানুষ সাইকেল করেই যাতায়াত করেন। পরিবেশের কথা ভেবে শহরে এই দূষণহীন, গ্রিনহাউস গ্যাস বর্জিত বাহন ব্যবহারকারীদের সরকার কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে পারে, যে ভাবে শিল্পে চালু হয়েছে কার্বন ক্রেডিট। বিনামূল্যে সাইকেল মেরামতির ব্যবস্থা করা, কয়েক বছর পর পুরনো সাইকেল বদলে সস্তায় নতুন সাইকেল দেওয়া ইত্যাদি অনেক রকম উপায় ভাবা যেতে পারে। কিন্তু শহরের দ্রুতগামী সড়কে সাইকেল চালানো বিপজ্জনক। তাই প্রয়োজন আলাদা সাইকেলপথ বা রাজপথে সাইকেলের জন্য চিহ্নিত আলাদা অংশ। কলকাতায় এখন বাইপাসে চলছে মহাযজ্ঞ, মাথার উপরে তৈরি হচ্ছে মেট্রো রেলের পথ (যথেচ্ছ গাছ কেটে ও কোনও নতুন গাছ না লাগিয়ে), তৈরি হচ্ছে বাসের জন্য বিশেষ পথ একই সঙ্গে করা হোক সাইকেলপথ। দু’পাশে থাকবে গাছের ছায়া। কলকাতায় যে সড়কগুলি তুলনায় প্রশস্ত, যেমন সাদার্ন অ্যাভিনিউ, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, আশুতোষ মুখার্জী-শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড, চৌরঙ্গিগামী রাস্তা, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, সেগুলিতে কিছু অংশ রং দিয়ে চিহ্নিত করে সাইকেলকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে এখনই। শুধু কলকাতা নয়, এ ভাবে ছোট শহরগুলি বর্ধমান, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর ইত্যাদিরাও পরিকল্পনা করুক সাইকেল বিপ্লবের। আমস্টারডাম, প্যারিস, বেজিংয়ের পর কলকাতার নামও উচ্চারিত হোক সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ধ্বনিতে। আমাদের শহরগুলো অন্তত আর একটু বাসযোগ্য হোক। |
|
প্রতি বছর মোট কত বাইসাইকেল তৈরি হচ্ছে পৃথিবীতে? সংখ্যাটা প্রায় ১৩ কোটির কাছাকাছি। আর মোটরগাড়ি? মোটামুটি ৬ কোটি। চাকার সংখ্যা প্রায় সমান সমানই দাঁড়াল। |
‘কুন্তলীন’ ও ‘দেলখোস’-এর আবিষ্কারক বিখ্যাত এইচ বসু (হেমেন্দ্রমোহন বসু) সাইকেলের দোকান খোলেন ও তিন স্যরকে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও নীলরতন সরকারকে সাইকেল শেখান। |
প্যারিসের ১২০০টি জায়গায় ১৮০০০ সাইকেল রাখা রয়েছে। নাম নথিবদ্ধ করে যে কোনও ভাড়ার জায়গা থেকে সাইকেল ভাড়া করে অন্য যে কোনও ভাড়ার জায়গায় ফেরত দেওয়া যায়। |
|
|
|
|
|
|