সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ ও ওষুধ কেনায় দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে নেমে রাজ্য সরকার এক আইএএস অফিসার এবং এক উচ্চপদস্থ আধিকারিককে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তদন্তের ফাইল ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মুখ্যসচিবকে। তদন্তে কিছু গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ায় দুই অফিসারের বিরুদ্ধে প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চলেছে বলেও মহাকরণ সূত্রের খবর। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মুখ্যসচিব তদন্ত কমিটির কাছে কয়েকটি বিষয়ে আরও তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য গুণমানের ওষুধ সরবরাহের লক্ষ্যে মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন নামে একটি নিগম গড়া হয়েছিল পূর্বতন বামফ্রন্ট আমলে। বিভিন্ন জেলায় সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো নির্মাণেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু নিগমের কাজকর্ম সম্পর্কে নানা মহল থেকে অভিযোগ ওঠায় বিধানসভার স্ট্যান্ডিং কমিটি স্বাস্থ্য দফতরকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। অর্থ দফতরও তদন্তে নামে। পরে অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে রাজ্যের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের সচিব জয়া দাশগুপ্তের নেতৃত্বে সচিব পর্যায়ে চার সদস্যের ‘প্রমাণ কমিটি’ গঠন করে রাজ্য।
এবং মহাকরণ-সূত্রের খবর: নিগম তার জন্মলগ্ন ইস্তক নানা অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিল বলে বিভিন্ন তদন্ত-রিপোটের্র্ মত প্রকাশ করা হয়েছে। যার জন্য কমিটি প্রাথমিক ভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছে নিগমের প্রাক্তন এক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং তদানীন্তন জেনারেল ম্যানেজারকে। রাজ্য প্রশাসনের সূত্রটি জানাচ্ছেন, রিপোর্ট খতিয়ে দেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নিগমের যে প্রাক্তন এমডি’র দিকে অভিযোগের আঙুল, সেই আইএএস অফিসার আপাতত কোনও দায়িত্বে নেই। তাঁকে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ রাখা হয়েছে। অভিযোগগুলো কী? |
গলদ গলদ |
• মেডিক্যাল সাপ্লাই কর্পোরেশনের উদ্দেশ্য অপূর্ণ
• নিগমের বার্ষিক সাধারণ সভা হয়নি
• নিগমের দৈনন্দিন কাজে অনিয়ম
• উত্তরবঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ
নির্মাণে চুক্তি লঙ্ঘন
• হাসপাতালে নিম্ন মানের ওষুধ
• ওষুধ খরিদে ১০০% অগ্রিম, কমিশন
• নিগমের এমডি’র অতিরিক্ত ব্যয় |
|
তদন্ত-রিপোর্ট মোতাবেক, যে উদ্দেশ্যে নিগম গড়া হয়েছিল তা সাধিত তো হয়ইনি, বরং কাজ শুরু করতেই চলে গিয়েছে বহু মূল্যবান সময়। নিগম পরিচালনাতেও অনিয়ম ধরা পড়েছে। বার্ষিক সাধারণ সভা ডাকা হয়নি, খাতাপত্র রক্ষণাবেক্ষণেও গলদ। দৈনন্দিন কাজকর্মে নিগমের যাবতীয় নিয়ম-কানুনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে।
যেমন, উত্তরবঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নক্শা তৈরি থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের বরাত এক বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল নিগমের পরিচালন কমিটির অনুমোদন ছাড়াই। চুক্তি অনুযায়ী যে সময়ে কাজ শেষ করার কথা ছিল, তা-ও মানা হয়নি। ফলে প্রকল্পের খরচ বেড়ে গিয়েছে।
একই সঙ্গে ওষুধ সরবরাহ নিয়েও বিস্তর অভিযোগ। কমিটির বক্তব্য: সরকারি হাসপাতালে উচ্চ মানের ওষুধ জোগাতে নিগম একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, যারা সে জন্য চুক্তি করে নিয়েছিল বিভিন্ন ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গে। ফলে পরিমাণে কম বা খারাপ ওষুধ এলেও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে নিগম কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অথচ দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে ওষুধ খরিদ বাবদ মূল সংস্থা ১০০% অর্থ অগ্রিম ছাড়াও আলাদা ‘চার্জ’ নিয়েছে!
নিগমের প্রাক্তন দুই কর্তার বিরুদ্ধে ওঠা ‘আর্থিক অস্বচ্ছতা’র অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে ‘বৈঠকের’ নামে সরকারি টাকায় যখন-তখন দিল্লি যাতায়াত। কমিটি বলেছে, অভিযুক্ত আইএএস অফিসার এ ভাবে দেড় বছরে ২১ বার দিল্লি গিয়েছেন। অধিকাংশ সময়েই কলকাতা ছেড়েছেন শুক্রবার রাতে কিংবা শনিবার সকালে, ফিরেছেন সোমবার দুপুরে। এর কোনও ব্যাখ্যা তদন্তকারীরা পাননি। স্বাস্থ্য দফতরে সে সংক্রান্ত কোনও নথিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। উপরন্তু নিগমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হওয়ার সুবাদে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না-দিয়েই উড়ান খরচ ও গাড়িভাড়া বাবদ লক্ষাধিক টাকা রাজ্যের কোষাগার থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯-এর অক্টোবর থেকে ২০১১-র অগস্ট পর্যন্ত মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশনের এমডি থাকাকালীন ওই আইএএস অফিসার রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রজেক্ট ডিরেক্টরের পদেও ছিলেন। তখন সরকারি নিয়ম ভেঙে তিনি দুই সংস্থা থেকেই বাড়ির টেলিফোন, ইন্টারনেট ও মোবাইলের বিল বাবদ ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে তদন্তে প্রকাশ।
স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের এবং অর্থ দফতরের তদন্ত-রিপোর্টের মূল বক্তব্য মোটামুটি এক। তবে আরও কিছু আধিকারিক এই দুর্নীতিতে জড়িত বলে তাঁদের কাছে খবর রয়েছে। সে সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো হাতে এলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |