|
|
|
|
বর্ষার ক্যালেন্ডার বদলে আশঙ্কায় আবহবিদেরা |
দেবদূত ঘোষঠাকুর • কলকাতা |
বর্ষা এসেছে ঠিকই, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে অনাবৃষ্টির পরিস্থিতি কাটল কোথায়! মেঘ উড়ে উত্তরে চলে চলে যাওয়ায় ফের তাপপ্রবাহের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গ (বুধবার কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে গিয়েছে ৩৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যা এ সময়ের স্বাভাবিকের থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি)।
পরিমণ্ডলের যা অবস্থা, তাতে চলতি মাসের মধ্যে সেই ঘাটতি মেটা মুশকিল। আবার আবহবিদদের আশঙ্কা, ঘাটতি কাটাতে জুলাই মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টির প্রয়োজন, তাতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কম বৃষ্টির জন্য জুন মাসে বীজতলা তৈরির কাজ পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু জুলাই মাসে সেই ঘাটতি মেটানোর বৃষ্টি হলে ধানের চারা জলে ডুবে যেতে পারে বলেও শঙ্কায় রয়েছেন আবহবিদেরা।
বর্ষা এসে কয়েক দিন বৃষ্টি নামিয়ে ফের হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে অবশ্য অস্বাভাবিকতা দেখছেন না আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বর্ষায় তিন মাস টানা বৃষ্টির কোনও নজির নেই। বৃষ্টি হয় কয়েকটা পর্যায়ে। প্রতিটি পর্যায়ে কখন বৃষ্টি হবে, কতটা বৃষ্টি হবে তা নির্ভর করে ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপ অক্ষরেখার উপরে। গত সপ্তাহে দক্ষিণবঙ্গে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন ঘূর্ণাবর্ত সক্রিয় ছিল দক্ষিণবঙ্গের উপরে। সে ক’টা দিন উত্তরবঙ্গের হিমালয় সংলগ্ন তিন জেলায় বৃষ্টি কমে এসেছিল।
রবিবার থেকে পাশা পাল্টেছে। ঘূর্ণাবর্তটি এখন সক্রিয় উত্তরবঙ্গে। তাই এখন বৃষ্টি পাচ্ছে উত্তরের তিন জেলা। দক্ষিণ খটখটে শুকনো। তাপমাত্রা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাড়ছে অস্বস্তিও। পরবর্তী পর্যায়ের বৃষ্টির জন্য আর একটি ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপের উপরে নির্ভর করতে হবে। জুনে আর তার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে দিল্লির মৌসম ভবন।
স্বাভাবিক নিয়মে সারা দেশে সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। তবে পশ্চিমবঙ্গ, গোটা উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ ভারত, পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতের একাংশে জুন এবং জুলাই এই দু’মাসেই সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয়। জুন মাসের বৃষ্টির নিরিখে উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে বর্ষা হয়েছে স্বাভাবিকের থেকে বেশি কিংবা স্বাভাবিক। কিন্তু গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণবঙ্গ-সহ গোটা পূর্ব ভারতে বর্ষা জুন মাসে আর পর্যাপ্ত বৃষ্টি দিতে পারছে না।
অস্বাভাবিকতা আরও আছে। স্বাভাবিক নিয়মে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বর্ষা পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে বর্ষা পিছিয়ে নভেম্বরের গোড়া পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। কিন্তু বর্ষার এই ব্যবহার স্থায়ী কি না, তা বুঝতে না পারায় চাষের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কি না সে ব্যাপারে এখনও দোটানায় কৃষি বিশেষজ্ঞেরা। কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কৃষি বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “আমরা এই সমস্যা কাটাতে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছি। বর্ষা স্থায়ী ভাবে তার সময় পরিবর্তন করল কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও পাঁচ-দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
চলতি বছরের মে মাসে দক্ষিণবঙ্গ আশানুরূপ বৃষ্টি পায়নি। বর্ষা দেরি করে ঢোকায় জুন মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেও বৃষ্টির ঘাটতি থেকে গিয়েছে গোটা দক্ষিণবঙ্গে। অন্য দিকে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই উত্তরবঙ্গে বর্ষা ঢুকে যাওয়ায় এবং মৌসুমি অক্ষরেখা অতি সক্রিয় থাকায় উত্তরবঙ্গে অতিবৃষ্টি হয়েছে। মাঝখানে দিন চারেক কিছুটা ঢিমে তালে চলার পরে চলতি সপ্তাহ থেকে ফের ভারী বর্ষণের মুখোমুখি তরাই ও ডুয়ার্স। তবে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনাবৃষ্টির মুখোমুখি উত্তরবঙ্গের তিন জেলা মালদহ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর।
১৭ জুন দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা ঢোকার সময়ে ওই অঞ্চলে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল ৫৮ শতাংশ। ১০ দিন পরে তা কমে হয়েছে ৩৪ শতাংশ। আবহবিদদের মতে, ১০ দিনে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে তা-ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন মুর্শিদাবাদে ১৮ জুন বর্ষার ঘাটতি ছিল ৪০ শতাংশ। দক্ষিণবঙ্গে এক সপ্তাহ বর্ষা সক্রিয় থাকার পরেও ওই জেলায় ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। আবার উত্তরবঙ্গে সামগ্রিক ভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেও মালদহে বৃষ্টির ঘাটতি রয়ে গিয়েছে ৪২ শতাংশ। দুই দিনাজপুরেও অনাবৃষ্টির পরিস্থিতি চলছে।
এ রাজ্যে বৃষ্টির যে ভারসাম্যহীন চেহারাটা ধরা পড়েছে, সেটাই এ বারের বর্ষার জাতীয় চিত্র বলে মন্তব্য করেছেন এক আবহবিদ। তিনি বলেন, “জুনের এ সময়টায় বর্ষা উত্তর ভারতে বর্ষা সক্রিয় থাকে। কিন্তু মৌসুমি অক্ষরেখার যা অবস্থান তাতে কবে উত্তর ভারতে এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে বর্ষা ঢুকবে তা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই পঞ্জাবে বৃষ্টির ঘাটতি পৌঁছেছে ৯৫ শতাংশে। হরিয়ানায় তা ৯৭ শতাংশ, উত্তরাখণ্ডে ৯৫ শতাংশ এবং দিল্লিতে ৭৪ শতাংশ।” মৌসুমি বায়ু মতিগতি না বদলালে উত্তর ভারত ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন জেলা খরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন ওই আবহবিদ।
বর্ষার মতিগতি এখনও স্বাভাবিক না হওয়ায় দেশে এ বার খাদ্যশস্যের উৎপাদন কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের কর্তারা। চিন্তিত অর্থনীতিবিদেরাও। কৃষি মন্ত্রকের কতার্রা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে যোগাযোগ করে সেখানকার পরিস্থিতি যাচাইয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রয়োজনে বিকল্প চাষের পরামর্শ দেওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা।
|
ঘাটতি মেটেনি |
জেলা |
কত ঘাটতি
(১৮ জুন) |
কত ঘাটতি
(২৭ জুন) |
নদিয়া |
৮২% |
৫৩% |
দক্ষিণ ২৪ পরগনা |
৮১% |
৫২% |
উত্তর ২৪ পরগনা |
৪৯% |
৪২% |
বর্ধমান |
৪৮% |
২৩% |
হুগলি |
৪৫% |
২১% |
মুর্শিদাবাদ |
৪০% |
৪৭% |
দক্ষিণবঙ্গ |
৫৮% |
৩৪% |
অতিবৃষ্টি |
জেলা |
কত বেশি
(১৮ জুন) |
কত বেশি
(২৭ জুন) |
জলপাইগুড়ি |
৯০% |
৭৬% |
কোচবিহার |
৮০% |
৪৫% |
দার্জিলিং |
৪০% |
৩১% |
|
|
|
|
|
|