|
|
|
|
পরম্পরার পাইক-নাচ আজও বেঁচে দুবড়ায় |
কিংশুক গুপ্ত • জামবনি |
অতিকায় এক ধামসা বাজছে, ‘দ্রি দ্রিম দ্রি দ্রিম’। সঙ্গে মাদলের বোল। ধামসা-মাদলের তালে-তালে নাচছে দশ জনের সুসজ্জিত দল। নৃত্যে ছৌ-নাচের আদল থাকলেও, কুশীলবদের কারও মুখোশ নেই। মূল চরিত্র কৃষ্ণ ও রাধা, সঙ্গে আরও ৮ জন সখা-সখী। সকলেই পুরুষ! কৃষ্ণের সখাদের হাতে বাঁশি। আর সখীদের পরনে ঘাগরা-চোলি।
তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও বিলুপ্তপ্রায় এই ‘পাইক-নাচ’ দেখতে পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনি ব্লকের দুবড়া গ্রামের মাঝিপাড়ার ভিড় কম হয়নি। গ্রামের ছেলে-বুড়োরা গোল হয়ে বসে দেখছেন পাইক-নাচের ‘বাউল-কৃষ্ণ’ পালা। নাচের এক-একটা ভঙ্গি দেখে তুমুল হাততালি পড়ছে। এক কোণে বসে নাচের প্রতিটি পদক্ষেপ খুঁটিয়ে দেখছেন বছর বত্রিশের ‘গুরু’ পরিমল দলাই। ‘শিষ্য’ মাধব সিংহ, নিতাই খামরুই, নুদু মল্লিকদের নাচে গ্রামবাসীরা যতই মাতোয়ারা হোন না কেন, গুরুকে সন্তুষ্ট করা বড় কঠিন! |
|
চলছে নাচের মহড়া। ছবি তুলেছেন দেবরাজ ঘোষ। |
প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে ঐতিহ্যের এই নৃত্যকলার সূচনা হয়েছিল ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে তৎকালীন রাজ অনুগ্রহে। পাইক-নাচ আসলে মুখোশ বিহীন ছৌ-নাচ। যতদূর জানা যায়, রাজার পাইক-বরকন্দাজেরা বাদ্যযন্ত্রের তালের অনুসঙ্গে যুদ্ধের আগে শারীরিক কৃৎকৌশল অনুশীলন করতেন। ‘রণবাদ্য’ অতিকায় ধামসা’র তালে তালে পাইকদের রণকৌশলের মহড়া চলত। পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে পাইক-নাচে রাধাকৃষ্ণের লীলা-কাহিনী আরোপিত হয়। বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, কয়েক শতাব্দী আগে চিল্কিগড়ের রাজার চৌকিদারেরা পাইক-নাচ শুরু করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। স্থানীয় দুবড়া, বেলিয়া, চিল্কিগড়, তুলসীবনির মতো গ্রামগুলিতে সেই চৌকিদারদের বংশধরেরা পাইক-নাচকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এখনও। দুর্গাপুজোর নবমীর দিন এখনও চিল্কিগড় রাজবাড়িতে পাইক-নাচের অনুষ্ঠান হয়। এ ছাড়া জামবনির ওই সব গ্রামে চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে পাইক-নাচ হয়। তবে দুবড়া গ্রামেই প্রকৃতপক্ষে গুরু-শিষ্য পরম্পরা আজও চালু রয়েছে।
কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই লোকশিল্পকে বংশ পরম্পরায় বাঁচিয়ে রেখেছে দুবড়ার মাঝিপাড়ার ৩৫টি তফসিলি জাতিভুক্ত পরিবার। মাঝিপাড়ার কিশোর ও যুবকেরা আজও পাইক নাচের তালিম নেন। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় তালিম দেন প্রবীণ শিল্পীরা। গ্রামের প্রবীণ শিল্পী অজিত দলাই, অমৃত খামরুই, ছোটু খামরুইদের বক্তব্য, “জামবনির চিল্কিগড়-রাজার যাঁরা পাইক ছিলেন, আমরা তাঁদেরই উত্তরসূরি। এই নাচের মধ্যে পূর্বপুরুষের স্মৃতি রয়েছে।”
গ্রামের ‘বকুল কুঞ্জ দুবড়া অগ্রগামী ক্লাবে’র সম্পাদক পরিমল দলাই জানান, ক্লাবের ২২ জন সদস্যের ১০ জন পাইক নাচেন। ৫ জন ধামসা-মাদল বাজান। চাষবাস ও দিনমজুরির কাজের ফাঁকেই কৃষ্ণ-রাধা সাজেন গ্রামের যুবক মাধব সিংহ, নুদু মল্লিকেরা। তাঁরা বলেন, “দাদু-ঠাকুরদাদের নাচতে দেখেছি। সাক্ষাৎ রাধা-কৃষ্ণ মনে হত। আমরাও নাচের সময় দুঃখ-কষ্ট ভুলে আনন্দসাগরে ডুব দিই।” গ্রামের স্কুল পড়ুয়া বিকাশ খামরুই, সাহেব দেহুরিরা জানায়, “বাড়িতে বাবা-কাকাদের কাছে নাচের তালিম নিই। আর একটু বড় হলে গুরুর কাছে যাব।”
গুরু পরিমলবাবু বলেন, “গল্পকথা শুনিয়ে নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের নাচ শিখতে অনুপ্রাণিত করা হয়। কিন্তু নাচের দল চালানোর অনেক খরচ। বাইরে একটা কি দু’টো অনুষ্ঠান করার ডাক পাই। তাতে দল চালানোর খরচ ওঠে না। তবু এ নাচ যেন নেশার মতো আমাদের রক্তে রয়েছে।”
সম্প্রতি পরিমলবাবুদের পাইক-নাচের দলটির পাশে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের ‘পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র’। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থানুকুল্যে বিলুপ্তপ্রায় পাইক-নাচের পুনরুজ্জীবনে মঙ্গলবার (২৬ জুন) থেকে দুবড়া গ্রামে শুরু হয়েছে পাইক-নাচের বিশেষ ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রকল্প’। ঝাড়গ্রাম মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তী বলেন, “সরকারি খরচে গ্রামেরই আগ্রহী তরুণদের দশ মাস ধরে পাইক-নাচের প্রশিক্ষণ দেবেন পরিমলবাবু। গুরু, শিক্ষার্থী ও বাদ্যযন্ত্রীদের প্রতি মাসে স্টাইপেন্ড দেওয়া হবে।” |
|
|
|
|
|