সকাল ৭টা। ঘরের ভেতর সারি সারি বসে পড়েছেন বন্দিরা। চোখ বন্ধ। মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে ‘ওং’ ধ্বনি। কখনও দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ছেন। কখনও শুয়ে পড়ে মগ্ন হচ্ছেন কোনও শব্দে। টানা দুই ঘন্টা এভাবেই কাটাচ্ছেন তাঁরা। শিলিগুড়ি বিশেষ সংশোধনাগারে এখন নিয়ম করে ‘ধ্যান’-এ বসছেন বন্দিরা। এর পরে যোগ ব্যায়ামও করছেন তাঁরা। সুযোগ পেলে টেলিভিশনের সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তিহার জেলের সেই ‘খুনখার’-অপরাধীদের কথা। জেল কর্তৃপক্ষের কথায়, ‘ধ্যান’-ই যাদের বদলে দিয়েছে। আপাতত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা বন্দিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণের পরে বন্দিদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে প্রশিক্ষক বানানো হবে। শিলিগুড়ি বিশেষ সংশোধনাগারের সুপার থুপদেন ভুটিয়া বলেন, “বন্দিদের মানসিক এবং শারীরিক দুই দিক দিয়েই পরিবর্তন ঘটাতে চাই আমরা। তারা বাইরে বেরনোর পর যাতে এক নতুন জীবনে ফিরতে পারেন, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তিহার জেল থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ধ্যান’ এবং ‘যোগ ব্যায়াম’ করানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। ‘আর্ট অফ লিভিং’-এর শিক্ষকরা নিয়মিত জেলে এসে তাঁদের পরামর্শ দিচ্ছেন।” তিনি জানান, ২৮ মে থেকে পর্যায়ক্রমে ৮ দিন করে ‘ধ্যান’ করানো হচ্ছে। ৪০ জন করে পর্যায়ক্রমে ওই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আরও প্রায় দেড় মাস ধরে ও প্রক্রিয়া চলবে। তারপর বন্দিদের মধ্যে থেকেই পারদর্শী একজনকে বেছে নিয়ে শিক্ষকের আসনে বসানো হবে। জেল সূত্রে জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি বিশেষ সংশোধনাগারের ৩০০ জনের বেশি বন্দি রয়েছে। এদের মধ্যে ১৯ জন মহিলা। খুনের অভিযোগে যাবজ্জীবন কাটানো রঞ্জনা তামাং, মাদক পাচারে অভিযুক্ত নানু দেবী, বিমল বসু-এর মধ্যেই ৮দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন তাঁরা নিয়মিত ধ্যান-এ বসছেন। কোচবিহারের কষালডাঙার বাসিন্দা মাদক পাচারে অভিযুক্ত বিমল বলেন, “ধ্যান করে আমার খুব উপকার হয়েছে। শরীর অনেক চনমনে লাগছে। আমার ৮দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আমি টানা ধ্যান করে যেতে চাইছি।” অন্য বন্দিরাও ওই ব্যপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন বলে জেল কর্তৃপক্ষের। জেলের এক কর্তা বলেন, “বন্দিরা যাতে কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ না করে সে জন্য তিহার জেলের বন্দিদের কথা আমরা টেলিভিশনের মাধ্যমে শোনাচ্ছি। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ধ্যান করানো হচ্ছে। তাতে অনেক বন্দি উপকার পেয়েছেন। তাঁরা পরবর্তীতে সে কথা জানিয়েছেন।” প্রশিক্ষক বিনোদ সারাবগি বলেন, “বন্দিরা মানসিক ভাবে অনেক সময় অবসাদগ্রস্ত হয়ে থাকে। সবসময় শারীরিক ভাবেও তারা সুস্থ থাকেন না। নিয়মিত ধ্যান, যোগ ব্যায়াম করলে তাঁরা সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। সে জন্যই আমরা তাঁদের পরামর্শ দিচ্ছি। তা কাজে লাগছে বলে বন্দিরা আমাদের জানিয়েছেন।” দার্জিলিং জেলা লিগাল এইড ফোরাম ওই কাজে সহযোগিতা করছেন। সংস্থার সম্পাদক অমিত সরকার বলেন, “আমরা অনেক বন্দিকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকি। তা ছাড়া আইন পরিষেবা সম্বন্ধেও তাদের সচেতন করা হয়। বন্দিরা যাতে মূলস্রোতে ফিরতে পারেন। তারা যাতে নতুন করে কোনও অপরাধে অভিযুক্ত না হন, সেটা আমরা চাই। তাই বন্দিদের কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে। একসঙ্গেই দুটো কাজ হচ্ছে। বন্দিদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।” |