ডাউহিল গেলে ইউরোপ ফাউ মেলে
হরের ঘিঞ্জি বাঁচিয়ে একশো ভাগ দূষণহীন, স্বাস্থ্যকর স্থান বলেই এখানে আসা। দেখার হল চিরকালীন ভালবাসার কাঞ্চনজঙ্ঘা। রোমি-সিপাইদোরা রাস্তার বাঁকের একই ভিউপয়েন্ট থেকে ঝরঝরে মেঘমুক্ত আকাশে এক দিকে মাউন্ট এভারেস্ট আর অন্য দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে, বুকের মধ্যে জমে থাকে।
ডাউহিলের আকাশ, বাতাস, মাটি, জল, পাহাড় সবই নয়ন মেলে দেখার। এখানেই ঘন সবুজ ধুপি গাছের আশ্চর্য কোলাজ। স্থানীয় অধিবাসীরা বলেন ধুপি গাছের আধিক্যই মেঘমহলে নাকি গোপন খবর পাঠায়। তাই তো, ডাউহিলে মেঘবালিকাদের অত ঘন ঘন অভিসারে আসা। সঙ্গে উপরি পাওনা প্রচুর লাল-গোলাপি রডোডেনড্রন। হাতছানি দিয়ে ডেকে মুহূর্তে আপনার করে নেয়।
ফরেস্ট রেস্টহাউস পায়ে পায়ে পেরিয়ে, বাঁক ঘুরলেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফরেস্ট স্কুল। এখানে বছরভর বিট অফিসারদের ট্রেনিং চলে। স্কুল চত্বর বিভিন্ন রঙের ফুলে ভরা, পরিপাটি করে সাজানো বাগান। সেখানে সুন্দর সাজানো, গোছানো কাঠের দোতলা বাড়িতে ফরেস্ট মিউজিয়ম। ১৯০৭ সালের ইংরেজ সাহেবদের হাতে সাজানো এই মিউজিয়ম। কত যে গাছের ফসিল ও কাঠের নমুনা রাখা তার ইয়ত্তা নেই। আছে বেশ কিছু লুপ্তপ্রায় প্রাণী ও পাখির দেহ, স্টাফ করা। দেখে অবাক হতে হয়।
একটু এগিয়ে দেখি পাহাড়ের ঢালকে কাজে লাগিয়ে এক প্রাকৃতিক চিড়িয়াখানা তৈরি হয়েছে। পোশাকি নাম ‘স্যাটেলাইট জু’। এই অদ্ভুত নাম দেওয়ার কারণ হয়তো উপগ্রহের মতো, পাহাড় থেকে বিরল পশুপাখিদের পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে। আমরা দেখলাম নতুন করে ফিজ্যান্ট ব্রিডিং সেন্টার তৈরি হচ্ছে পাহাড়ের ঢালে ঢালে। ডিয়ার পার্কও আছে। হিমালয়ের নানা রকমের বনচর ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে।
কিছু দূরে একই রাস্তার উলটো দিকে একটা পাহাড় জুড়ে তৈরি হচ্ছে বটানিক গার্ডেন ‘আরবোরেটম’। কত বিচিত্র ধরনের গাছ রডোডেনড্রন, ম্যাপল, ওক, ম্যাগনোলিয়া, সিলভার ফার, ট্রি-ফার্ন-এর দু’তিন রকম প্রজাতি। অর্কিডের জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা অঞ্চলই রয়েছে। সেখানে নিপুণ ভাবে, যত্ন করে, সহায়ক দূষণমুক্ত আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে অর্কিডগুলোকে রক্ষা করা হচ্ছে। ডাউহিলের গর্ব করার মতো বিষয় হল ওষধি গাছ। গাড়োয়াল, কুমায়ুন ছাড়া এত রকমের ওষধি হিমালয়ের আর কোত্থাও মেলে না। তাই বুঝি এখানে ডাক্তার বা ডাক্তারখানার দেখা নেই।
ফুলে প্রজাপতিতে বিভোর হয়ে উঠে এলাম পাহাড় চূড়ায়। সেখানে একটা গোল টিনের টোং-এর ঘর। ক’টা চেয়ারও পাতা, ক্লান্তি কাটানোর জন্য। পরে দেখি এটাই ভিউ পয়েন্ট। হাত বাড়ালেই পাওয়ার মতো কাঞ্চনজঙ্ঘা ঠায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখা দেবে বলে। আসলে ডাউহিল হল চিরযৌবন ও তারুণ্যের প্রতীক।
আরে, সামনে ওটা সাপ নাকি? আঁতকে উঠি। পর মুহূর্তেই আবিষ্কার করি, ওটা আসলে স্নেক লিলি। নিজেকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এমন ক্যামোফ্লেজ। অপলকে চেয়ে থাকি এই অদ্ভুত প্রাকৃতিক মিমিক্রি-র দিকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আষ্টেপৃষ্ঠে উপভোগ করে আমরা সাবধানে নামতে লাগলাম। কারণ, চড়াই ভেঙে উঠতে কষ্ট হলেও উৎরাইয়ের সময় ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। রাস্তার এক পাশে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত রেঞ্জার্স ট্রেনিং কলেজ। এখানে সারা ভারত থেকে কর্মীরা আসেন বন ও বন সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে।
ডাউহিলের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসের পাশে ভিক্টোরিয়া স্কুল। লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যাশলে ইডেন ১৮৭৯ সালে মাত্র ষোল জন শিক্ষার্থী নিয়ে ডাউহিলের সবুজ সমুদ্রে এই বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ফুলের বাগানের মধ্যে স্কুলবাড়ির স্থাপত্য মুহূর্তে ইউরোপে পৌঁছে দেয়।
ডাউহিলের ফরেস্ট স্কুল দেখেছি, রেঞ্জার্স ট্রেনিং কলেজ দেখেছি, অথচ জঙ্গলে ট্রেক করব না, তাই কখনও হয়? ওষধিগাছ-বিশেষজ্ঞ পুরম শর্মাকে গাইড হিসেবে পেয়ে আমরা রওনা দিলাম। ডাউহিল থেকে একটা গিরিসংকট ধরে এগিয়ে চললাম চিত্রে গ্রাম পর্যন্ত। এ বার সেখান থেকে উঁচু-নিচু পথ ধরে দেওরালি গ্রাম হয়ে ঢুকে গেলাম ঘন জঙ্গলে। মেঘ-কুয়াশায় জড়াজড়ি আবহাওয়ায় হঠাৎ সব দৃশ্য ভ্যানিশ। পথ বলে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। পুরম ইয়ং পাহাড়ি ছেলে। অক্লান্ত কৌরবের মতো আমাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে। এটা-ওটা, গাছ-পাতা-ফুল চেনায়। ওষধিগাছের স্থানীয় ও বোটানিক্যাল নাম বলে। গাছের কোন অংশ, কোন ঋতুতে ওষুধ হিসেবে সংগ্রহ করা হয় সব ওর নখদর্পণে।
মেঘের অন্ধকারে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পুরম যতই বিড়বিড় করে বীরত্ব দেখাক, ও কিন্তু বনের মধ্যে পথ হারিয়েছে। খানিক গোলকধাঁধার মতো আমরা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি। আমরা কয়েকটি প্রাণী যেন পৃথিবীর কোনও আদিম রহস্য উন্মোচনের আশায় ঘরদোর ছেড়ে ‘পথ হারাবো বলেই এ বার পথে নেমেছি’। ভরদুপুরে একটানা কটকট করে ডেকে চলেছে ঝিঁঝি পোকা। হঠাৎ একটা কাঁটা ঝোপের মধ্যে আমরা বন্দি। পুরমভাই প্রাণপণে ওর কোমরে গোঁজা কুকরি দিয়ে ডাল কাটতে লাগল। অবশ্য একটু পরেই পুরম শর্মার পরম ভরসায় আমরা আমাদের পথ খুঁজে পেলাম। অবশেষে প্রায় ঘণ্টা চারেক ট্রেকিং-এর পর মেটালিক রোডে নেমে এসে যেন বুক ভরে গেল। পুরমভাইকে বিদায় জানিয়ে, বার বার ডাউহিলে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করে পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পদচারণায় আমরা কার্সিয়াং শহরে পা রাখলাম, পরম তৃপ্তি আর নিশ্চিন্ত ভাব বুকে করে।

কী ভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি পৌঁছে কার্সিয়াং যাওয়ার রাস্তায় দু’আড়াই ঘণ্টায় ৪৮ কিলোমিটার পথ যেতে হবে। পথের দু’ধারে মিলিটারি ক্যাম্প আর চা বাগান ছেয়ে আছে। এ ছাড়া শিমূলবাড়ি চা বাগান ভায়া রোহিণী হয়েও যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন
ডাউহিলে তেমন থাকার জায়গা নেই। আদর্শ হবে কার্সিয়াংকে ঘাঁটি হিসেবে রেখে ডাউহিল ঘোরা। এখানে বন উন্নয়ন নিগমের একটা সুন্দর ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। তাতে ডাবল বেড-সহ বড় বড় ঘর, সোফা সেটে সাজানো ড্রয়িং রুম, প্রশস্ত গাড়ি বারান্দাও রয়েছে। শৌখিন, সুসজ্জিত পরিবেশ। তা ছাড়া, তত্ত্বাবধানে থাকা চৌকিদার বা মালিকে বলে দিলে অল্প দামে ভাল মিলও পাওয়া যায়। তবে এই ছবির মতো রেস্টহাউসটিতে থাকার জন্য বন দফতরের কোনও উচ্চপদস্থ অফিসারের পরিচিতি আবশ্যক।


যোগাযোগ
৬এ, সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার (অষ্টম তল), ধর্মতলা, কলকাতা- ১৩।
ফোন নম্বর- ২২৩৬-৫২০২, ২২১২-০৬৮৪।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.