|
|
|
|
সিঙ্গুর আইন অবৈধ, রায় ডিভিশন বেঞ্চের |
অরুণোদয় ভট্টাচার্য • কলকাতা |
রাজ্য সরকারের সিঙ্গুর আইনকে ‘অসাংবিধানিক এবং অবৈধ’ বলে রায় দিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
শুক্রবার ওই আইনের বিরুদ্ধে টাটাদের দায়ের করা আপিল মামলার রায় দিয়ে বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ ও বিচারপতি মৃণালকান্তি চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, রাজ্য সরকার যে আইনের বলে টাটাদের জমি পুনরায় দখল করেছে, তা ‘আইনানুগ’ নয়। ওই আইনের অন্তত তিনটি ধারা সরাসরি জমি অধিগ্রহণের কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে ‘সংঘাতপূর্ণ’। সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য রাজ্যকে দু’মাস সময় দিয়েছে কোর্ট। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাজ্য ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার। দলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপাতত সেই মর্মেই নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশ্যে অবশ্য মমতা ওই রায় নিয়ে বিশদে কোনও মন্তব্য করেননি।
বিশদ মন্তব্যে যায়নি টাটা মোটরসও। তাদের মুখপাত্র শুধু বলেছেন, “কলকাতা হাইকোর্টের রায় টাটা মোটরস খতিয়ে দেখবে।” |
|
অধিগ্রহণে হারিয়েছিলেন চাষের জমি। প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষতিপূরণ নেননি। আশা ছিল,
জমি ফেরত পাবেন। কিন্তু ছ’বছর পরেও সিঙ্গুরের সঙ্গী হতাশাই। |
তবে আদালতের এ দিনের রায়ের পরও এখনও আইনত সিঙ্গুরের জমি টাটাদের হাতে যাচ্ছে না। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওই জমিতে ‘স্থিতাবস্থা’ রয়েছে। হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন যাতে রাজ্য সরকার ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরত দিতে না পারে, সে জন্যই সুপ্রিম কোর্টে টাটারা আবেদন জানিয়েছিল। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই সর্বোচ্চ আদালত ওই ‘স্থিতাবস্থা’র নির্দেশ দেয়। এ দিন আদালতের রায়ে রাজ্যের পুনরায় জমি অধিগ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলা হলেও সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশের জন্যই সিঙ্গুরের জমি এখনই হাতে টাটারা পাচ্ছে না।
রায় ঘোষণার পর রাজ্য সরকারের পক্ষে আইনজীবী কল্যাণবাবু জানান, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। বস্তুত, কল্যাণবাবুর কথায়, “ফল তো ১-১ হল। চূড়ান্ত লড়াই এখনও বাকি আছে।” তাঁর আরও দাবি, “এই রায় আইনের চোখে দাঁড়াবে না। এতে সংবিধানকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে মনে করি না। আমরা আপিল করতে চাই।” তৃণমূলের একাংশ অবশ্য মনে করে, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার আগে আইনি দিকটি আরও খতিয়ে দেখা উচিত। তেমন হলে সম্পূর্ণ নতুন একটি আইন তৈরির দিকেও যাওয়া যেতে পারে। যে হেতু বর্তমান আইনটিতে রাষ্ট্রপতির সই নেই। তবে রাত পর্যন্ত উচ্চতম আদালতে যাওয়ার পক্ষেই পাল্লা ভারী। দলের এক নেতার কথায়, “আমরা সমস্ত রাস্তাই ধরব। সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া সেগুলোরই একটা।”
হারের ‘দায়’ স্বীকার করে সরকারি কৌঁসুলি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সরকার আইন করে মানুষের ভালর জন্য। মমতা যা করেছিলেন। এ বার দায়িত্ব বর্তায় আইনজীবীদের উপর। তাঁদের উচিত ঠিক করে ব্যাখ্যা করা। হয়তো আমাদের কোনও ভুলত্রুটি হয়েছে। যখন আইন তৈরি হয়, আমরাই পরামর্শ দিই। যাঁরা রাজনীতি করেন বা সরকার চালান, তাঁদের এত কূটকচালির মধ্যে যাওয়া সম্ভব নয়!” |
|
এ ভাবেই পড়ে রয়েছে ন্যানো কারখানার জমি। শুক্রবার সিঙ্গুরে। |
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে সিঙ্গুরের ৯৯৭ একর জমি ন্যানো কারখানা তৈরির জন্য টাটাদের ‘লিজ’ দিয়েছিল সাবেক বাম সরকার। এর মধ্যে অন্য ভেন্ডারদের জমিও ছিল। ওই পুরো জমিই ফেরত নিয়ে নেয় বর্তমান রাজ্য সরকার। আদালত এ দিন রায় দিতে গিয়ে বলেছে, অনুসারী শিল্পের জমি নিয়ে নেওয়াটাও ‘অবৈধ’ কাজ হয়েছে। আইন করে অনুসারী শিল্পের জমি নেওয়া হলেও তার মালিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনও কথা হয়নি।
আরও বলা হয়েছে, ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমির পরিমাণের কোনও প্রামাণ্য তথ্য রাজ্য সরকার আদালতকে দিতে পারেনি। ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, ‘জনস্বার্থে’ সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের ৪০ থেকে ৪০০ একর জমি ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। এটা ‘সংবিধান-বিরোধী’।
কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, রাজ্য সরকারের নতুন আইনের ৪, ৫ এবং ৬ নম্বর ধারা সরাসরি কেন্দ্রীয় আইনকে ‘আঘাত’ করেছে। কেন্দ্রীয় আইনের মূল নীতিকে তা ‘বিঘ্নিত’ করেছে।
সিঙ্গুর-মামলায় গত বছর রাজ্য সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে টাটা গোষ্ঠী। এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের সেই রায়ও খারিজ করে দেয়। ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, জমি অধিগ্রহণ সংবিধানের ‘যৌথতালিকা’ভুক্ত বিষয়। ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন কেন্দ্রীয় আইন। রাজ্য সরকার প্রয়োজনে সেই আইন সংশোধন করতে পারলেও সেই সংশোধন করতে হবে মূল কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে ‘সঙ্গতি’ রেখেই। কোনও ‘সংঘাত’ তৈরি করা যাবে না।
বিচারপতি মুখোপাধ্যায় তাঁর রায়ে রাজ্যের নতুন আইনের মধ্যে মূল কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইনের ২৩ এবং ২৪ নম্বর ধারা সংযুক্ত করার কথা বলেছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, আদালত কোনও কিছু সংযোজন বা নতুন করে লেখার নির্দেশ দিতে পারে না। আবেদনকারী হাইকোর্টের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটি বৈধ না অবৈধ। কিন্তু বিচারপতি সেই আর্জির বিচার না করে তাঁর রায়ে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে আইনটি বৈধ হতে পারে, সেটা আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। |
রায় একনজরে |
• সিঙ্গুর জমি আইন অসাংবিধানিক এবং অবৈধ
• কেন্দ্রীয় আইনকে আঘাত করেছে এই আইন
• আইনটি লঙ্ঘন করেছে ২৫৪ ধারা
• রাজ্যের আইনে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেওয়া হয়নি
• অধিগৃহীত জমি জনস্বার্থের নামে জমিদাতাদের ফেরানো যায় না
• রাজ্যের আইনে অনুসারী শিল্পমালিকদের ক্ষতিপূরণের কথা নেই
• সুপ্রিম কোর্টে যেতে রাজ্যকে দু’মাস সময় |
|
আইনজ্ঞ মহলের বক্তব্য, জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি যৌথ তালিকায় পড়ে, যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েই আইন প্রণয়ন করতে পারে। যদি রাজ্যের কোনও আইন কেন্দ্রীয় আইনকে আঘাত করে বা লঙ্ঘন করে, তবে সেই আইনকে অবৈধ বলেই
গণ্য করা হয়। ডিভিশন বেঞ্চের
এ দিনের রায়েও উঠে এসেছে এই যুক্তিগুলি। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় উল্লেখ করে ডিভিশন বেঞ্চ দেখিয়েছে, কী ভাবে রাজ্য সরকারের নতুন আইন কেন্দ্রীয় আইনের মূল জায়গায় ‘আঘাত’ করেছে। তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, এক বার অধিগ্রহণ করা জমি জনস্বার্থের নামে জমিদাতাদের ফেরানো যাবে না। প্রয়োজনে তা অন্য ‘জনস্বার্থমূলক’ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই সিঙ্গুর আইনে রাজ্য ‘অনিচ্ছুক’দের জমি ফেরত দেওয়ার কথা বলে কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধিতা করেছে। অধিগৃহীত জমি জনস্বার্থে ব্যবহার করা না গেলে আইন অনুযায়ী সে জমি রাজ্য সরকার নিলাম করবে। কেন্দ্রীয় আইন সেটাই বলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন বহু উদাহরণও রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, রাজ্য কোনও কেন্দ্রীয় আইনের সংশোধন করলে তা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপাল সই করার পর রাষ্ট্রপতিকে পাঠাতে হয়। রাষ্ট্রপতি সই করার পরেই তা ‘বৈধ’ হয়। তখন সেই আইন অনুযায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। রাজ্য সরকার নতুন আইনটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়নি। অথচ ওই আইনের বলে রাজ্য সরকার টাটাদের লিজে পাওয়া জমি দখল করেছে।
রাজ্য উচ্চতম আদালতে যাওয়ার কথা যেমন ভাবছে, তেমনই টাটারাও ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে ‘ক্যাভিয়েট’ করেছে। তেমন হলে আইনি লড়াই এখনও বাকি। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মমতা। প্রথমে অর্ডিন্যান্স, পরে তা নিয়ে ‘জটিলতা’ হওয়ায় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র (অনিন্দ্যবাবু এ দিন আদালতে ছিলেন না) এবং কল্যাণবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত নতুন আইন তৈরি করেন। যার নাম ‘সিঙ্গুর জমি পুনর্বাসন ও উন্নয়ন আইন ২০১১’।
আদালতের এ দিনের রায়ের পর সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হল। টাটা গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকার দু’পক্ষই এখনও নিজেদের অবস্থানে ‘অনড়’।
সিঙ্গুরের হাজার একরের ভবিষ্যৎ আপাতত সেই আইনি লড়াইয়ের মারপ্যাঁচেই আটক!
|
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
|
|
|
|
|