এখনই ‘হতাশ’ নন, দলের অন্দরে বার্তা দিলেন মমতা
তিনি ‘হতাশ’ নন। এবং তিনি ‘মাথা নত’ করবেন না। শুক্রবার দুপুরে সিঙ্গুর-রায়ের পর এই হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া।
তবে প্রকাশ্যে নয়। দলের অন্দরে।
ইদানীংকার রেওয়াজ চালু রেখেই প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন তাঁর ফেসবুক পোস্ট-এ। যা বলছে, ‘সিঙ্গুর মামলার রায় নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। সারা জীবন ধরে আমি কৃষক, শ্রমজীবী, গরিব এবং সহায় সম্বলহীন মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। এঁদের পাশে থাকার দায়বদ্ধতা থেকে আমি সরছি না, ক্ষমতায় থাকি বা না থাকি। আমার এই লড়াই চলবে। গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই শেষ কথা’।
এ দিন যে বেলা গড়ানোর আগেই সিঙ্গুর-মামলার রায় বেরোবে, জানতেন মুখ্যমন্ত্রী। জানতেন এ-ও যে, এই মামলার রায় তাঁর সরকারের পক্ষে না-গেলে কী হতে পারে। কারণ, গত প্রায় আট বছর মমতা এবং সিঙ্গুর কার্যত সমার্থক। সিঙ্গুরের ওঠাপড়ার সঙ্গে তাঁর ওঠাপড়াও জড়িত।
রায় যখন দেওয়া হচ্ছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা কক্ষে এসে গিয়েছেন। বেলা ১১টায় সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরে ঢোকেন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। তিনি যখন নিজের আসনের দিকে যাচ্ছেন, তখনই হাতের ইশারায় তাঁকে ডেকে নেন মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা হয়। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী ডেকে নেন হরিপালের বিধায়ক তথা সিঙ্গুর জমি-আন্দোলনের নেতা বেচারাম মান্নাকে। মুখ্যমন্ত্রীর পিছনের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়েন বেচারাম। তাঁর মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ কথা বলেন মমতা। ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ ঠিক করতে আজ, শনিবার বিকেলে টাউন হলে সিঙ্গুর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের (রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক) নিয়ে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
সিঙ্গুর-রায়ের পর মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র
কী বলছিলেন সিঙ্গুর-আন্দোলনের সর্বময় নেত্রী? আদালতের রায় জেনে যাওয়ার পর? বলছিলেন, ধৈর্য ধরতে। বলছিলেন, হতাশ না-হতে। বলছিলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ তিনি বলে দেবেন। বিধানসভা ছেড়ে যাওয়ার আগে বেচারাম বলছিলেন, “ইতিমধ্যেই সিঙ্গুরে সভা করেছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। যে ভাতাটা দিদি চালু করেছেন, সেটা দেওয়ার শুরু হয়েছে। তবে ওটা আরও আগে চালু করলে বোধহয় ভাল হত।” আর মহাকরণে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী তথা সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন, “ছ’বছর যখন অপেক্ষা করা গিয়েছে। আরও ছ’মাস অপেক্ষা করা যাবে।”
সভাকক্ষে এক ঘণ্টারও বেশি ছিলেন মমতা। এক বারই কয়েক মিনিটের জন্য বেরিয়েছিলেন। এ দিনের মতো সভা ছেড়ে যান বেলা ১২টা নাগাদ। বিধানসভায় নিজের ঘরে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তখন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ। কিছুক্ষণ পরে হাইকোর্ট থেকে আসেন দলের আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডেপুটি স্পিকার এবং মন্ত্রীরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা সেরে বেরিয়ে এলে কল্যাণবাবুকে নিয়ে ঘরের লাগোয়া অ্যান্টি-চেম্বারে একান্ত বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ তিনি চলে যান মহাকরণে। কল্যাণবাবুকে সঙ্গে নিয়েই। তৃণমূল সূত্রের খবর, কল্যাণবাবু দলনেত্রীকে জানান, রাজ্য সরকার জমি ফেরত দিতে পারবে না, সেটা যেমন আদালত বলেছে, তেমনই এমনও বলেনি যে, টাটাদের জমি দিয়ে দিতে হবে। পরেও কল্যাণবাবু বলেন, “রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে না-গেলেও কিন্তু টাটা সিঙ্গুরের জমি হাতে পাচ্ছে না!”
কল্যাণবাবুর সঙ্গে আলোচনার পর মহাকরণে যাওয়ার আগে বিধানসভায় অপেক্ষারত সংবাদমাধ্যমকে মমতা যা বলে যান, তা তাঁর ফেসবুক পোস্ট-এর থেকে খানিকটা দীর্ঘ হলেও বিশেষ আলাদা নয়, “আদালতের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না। সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি রাজ্য সরকার ফেরত দেবে। সরকার এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। খেতমজুরদের জন্য মাসিক হাজার টাকার ভাতা চালু থাকবে। কৃষকদের কাছেও সরকারের দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের ইস্তাহারেও সে কথা আছে। আমরা চাষিদের পাশে ছিলাম-আছি-থাকব। আশা করি, চাষিরাই জিতবেন।”
রাজ্য সরকার কি সুপ্রিম কোর্টে যাবে?
মমতা বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে।”
ততক্ষণে অবশ্য বিরোধীদের ‘আক্রমণ’ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেছেন, “আমরা তো আগেই বলেছিলাম, ওই আইন অসাংবিধানিক। বিকল্প প্রস্তাবও ওঁকে দেওয়া হয়েছিল। বলেছিলাম, আমরা সরকারে থাকলে শিল্পই করতাম। কিন্তু উনি মানুষের রায় পেয়েছেন। জমি ফেরত দিতে চাইলে দিন। আমরা বিরোধিতা করব না। কিন্তু তা করতে হলে দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আনতে হবে। বলেছিলাম, ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক প্রভেদ করবেন না। জমি ফেরাতে হলে সকলকেই ফেরত দিন।”
সন্ধ্যায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের পর একই ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘রাজনৈতিক আক্রমণ’ করেছেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য নিরুপম সেন। তাঁর কথায়, “আইনটি পেশ করার সময় থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। জমি অধিগ্রহণ আইন যৌথ তালিকাভুক্ত। কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া এ ভাবে অধিগৃহীত জমি রাজ্য ফেরত দিতে পারে না।”
তিনি শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন সিঙ্গুরে অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়া দাবি বারবার উঠেছিল জানিয়ে নিরুপমবাবু বলেন, “আইনজ্ঞদের মতামত নিয়েই তখন বলেছিলাম, এ ভাবে অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। বরং জমিদাতাদের কত ভাল ভাবে পুনর্বাসন দেওয়া যায়, তা দেখা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিরোধীদের সেই সত্য বোঝাতে পারিনি। ফলে কারখানা রাজ্য ছেড়ে চলে গেল! রাজ্যের বড় ক্ষতি হল।” বস্তুত, রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টেও জিতবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নিরুপমবাবু বলেন, “যাঁরা ভেবেছিলেন, কারখানা হলে কর্মসংস্থান হবে, কারখানা না-হওয়ায় তাঁরা হতাশ। যাঁরা জমি ফেরত পাবেন ভেবেছিলেন, তাঁরাও হতাশ। এত বড় শিল্প না হওয়ায় গোটা দেশে এ রাজ্যের যে নেতিবাচক ও শিল্প-বিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে উঠল, সে ক্ষতি কবে তা পূরণ হবে জানি না!”
আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমির পরিমাণ প্রসঙ্গে নিরুপমবাবু বলেন, “আমি বারবার বলেছিলাম, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমির পরিমাণ কখনওই ৪০০ একর নয়। অনেক কম। সেটাই প্রমাণিত হল। কিন্তু তৎকালীন বিরোধীপক্ষ ও কিছু সংবাদমাধ্যম মিথ্যা প্রচার করে রাজ্যে এত বড় শিল্প হতে দিল না!”
অতঃপর কী?
সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনে মমতার একদা শরিক এসইউসি চায় সিঙ্গুরের ‘সংগ্রামী’ কৃষক সমাজ নিজেদের জমি ‘পুনর্দখল’ করুক! রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবু মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পরিবর্তে রাজ্য সরকার টাটাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এবং যা চায় শিল্পমহলও। ঘটনাচক্রে, রাজ্য বিজেপি-ও একই কথা মনে করে। তারা এ ব্যাপারে রাজ্যপালের ‘হস্তক্ষেপ’ চেয়ে চিঠিও লিখছে।
কিন্তু ‘হতাশ’ না-হওয়া এবং ‘মাথা নত’ করতে নারাজ মমতা কি আলোচনার টেবিলে বসবেন? তাকিয়ে আছে সিঙ্গুর। তাকিয়ে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.