গঙ্গার পশ্চিমতীরের সুপ্রাচীন নগর নবদ্বীপের পথে পথে রথযাত্রার দিন যে সব রথ বেরোয়, সময়ের রথে চড়ে তার কোনও কোনওটা পেরিয়ে যায় তিনশো, আড়াইশো বা নিদেনপক্ষে একশো বছর। কোনও রথ প্রথমবার পথে নেমেছিল কোনও জমিদারের উদ্যোগে। যেমন মুখোপাধ্যায় বাড়ির রথ। কোনওটা বা ধরে রেখেছে কোনও ভক্তের স্মৃতি। যেমন বালক সাধুর রথ। রয়েছে গৌড়ীয় মঠ, সারদেশ্বরী আশ্রম সহ আরও অনেক মঠের রথও। কিছু রথ সঙ্গে নিয়ে চলেছে সমাজ, অর্থনীতির ভাঙনের কাহিনিও।
কোনও রথ আবার বয়ে চলেছে রাজকন্যার কাহিনি। ভারতের পূর্বপ্রান্তের রাজ্য মণিপুরের মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র সেই ১৭৯৭ সালে নবদ্বীপে আসেন পরম বৈষ্ণব রাজকন্যা বিম্ববতীকে সঙ্গে নিয়ে। সেই মণিপুর রাজকন্যার ইচ্ছেতেই গড়ে ওঠে মণিপুরীদের প্রাসাদ। সেই থেকেই চলছে মণিপুর রাজবাড়ির রথও। সেই রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে এখনও বসে নৃত্যগীতের আসর। গাওয়া হয় জয়দেবের পদ। সপ্তাহকালব্যাপী চলে সেই উৎসব। রাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আরও রথের। সুদূর অতীতের মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের প্রধানমন্ত্রী এবং সুবিখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিত হলায়ুধের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ হলেন জগন্নাথ গোস্বামী। তাঁর প্রবর্তিত ওপার বাংলার সুখ্যাত রথের চাকা এসে পড়েছিল নবদ্বীপে। তবে বেশ কয়েকবছর হল বাসুদেবের রথ নামে সেই রথ আর চলে না। লোকাভাব, অর্থাভাব এই দু’য়ের যৌথ আক্রমণের কাছে হেরে উৎসবের দিন বউবাজারের বাসুদেব অঙ্গনে একা নিথর দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। অথচ সাড়ে পাঁচশো বছর আগে ঢাকার বিক্রমপুরে চৈতন্যপার্ষদ জগন্নাথ গোস্বামী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই বাসুদেব মূর্তির সন্ধান পেয়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে। একটি পুকুর থেকে তোলা হয়েছিল কষ্টিপাথরের প্রায় চার ফুট উঁচু অপূর্ব সুন্দর এই বিষ্ণুমূর্তিটি। সেখানেই মহাসমারোহে প্রতিষ্ঠাও করা হয়েছিল। তখন সেখানে তাঁর নাম ছিল যশোমাধব। তাঁকে ঘিরে উন্মাদনারও শেষ ছিল না। জগন্নাথ গোস্বামীর পরিবারের শচীনন্দন গোস্বামী ১৯৪৫ সালে দেশভাগের আগেই সেই বিগ্রহ চলে আসেন নবদ্বীপে। এখানে আসার পরে তাঁর নাম হয় বাসুদেব। বর্তমান সেবাইত শ্যামলকৃষ্ণ গোস্বামীর আক্ষেপ, “আমরা এখানে এসে পঞ্চাশ বছর ধরে রথযাত্রার আয়োজন করেছি। তারপরে একটা সময়ে আর পারলাম না। নানা জায়গায় ছুটেছি, কোনও সাহায্য পাইনি।”
তবে এ ভাবে থেমে যাওয়া রথের নতুন করে পথচলা শুরুর কাহিনিও রয়েছে চৈতন্যধাম নবদ্বীপে। প্রায় সোয়াশো বছর আগে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সূচনা হয়েছিল শচীনন্দন মহারাজের রথযাত্রার। তখন সে রথে চড়তেন শচীনন্দনের আরাধ্য গিরিধারী আর রাধারানি। তাঁর মৃত্যুর পরে বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল সেই রথ। ২০০৯ সাল থেকে প্রাচীন মায়াপুরের গিরিধারী আশ্রম থেকে সেই রথ আবার বেরোচ্ছে। তবে নতুন রথে থাকছেন সপার্ষদ জগন্নাথ এবং মহাপ্রভু। আবার ময়মনসিংহের এক অজ পাড়া গাঁ বড়বাঁসালিয়া। প্রায় একশো পনেরো বছর আগে সে গ্রামের মেঠো পথে এক বছর ছয়েকের বালকের টানে পথ চলা শুরু হয়েছিল সেই রথের। এর পর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। সেই ময়মনসিংহের রথ এখন নবদ্বীপে। প্রাচীন মায়াপুরে জগন্নাথ বাড়ির তত্ত্বাবধানে এখন সেই রথ চলে। বালক সাধুর সেই রথ অবশ্য এখন আর বাঁশের নেই। কিন্তু ধরে রেখেছে সেই স্মৃতি।
মায়াপুরের ইসকনের রথে এ বার এসেছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, উপস্থিত ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী লোপামুদ্রাও। রথের রশিতে টান দেওয়ার আগে সুব্রতবাবু বলেন, “নদিয়ার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। এখানে এসে সে সব মনে পড়ছে। নবদ্বীপ-মায়াপুরকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্রের কাজ যাতে দ্রুত হয়, সে জন্য চেষ্টা চলছে।”
দুপুর থেকেই জনতার ঢল নামে মায়াপুর রোডে। রাজাপুর থেকে মায়াপুর ইসকন মন্দির পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথের দু’ধারে মেলা বসে। মেলা বসে যায় দু’পাশে। প্রায় একই ছবি নবদ্বীপেও। পোড়া মা তলায় প্রধান মেলাটি হলেও শহরের দক্ষিণে মণিপুর, উত্তরে প্রাচীন মায়াপুর এবং পশ্চিমে প্রতাপনগরে রথকে ঘিরে আলাদা ভাবে ভিড় চোখে পড়ে। সেই সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজোর আয়োজনও। |