মহা ফ্যাসাদে পড়েছেন সৌমিত্র চৌধুরী। ১৮ বছর ধরে স্বগৃহে থাকার পরে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে কেমোথেরাপির এই প্রধানকে শুনতে হচ্ছে, তিনি ‘ভুল’ জমিতে বাড়ি করেছিলেন।
১৮ বছর আগে রাজারহাটের মহিষবাথানে জমি কিনে একতলা বাড়ি তৈরি করেছিলেন সৌমিত্রবাবু। এত বছর পরে তাঁর বাড়ির আশপাশের অনেক জমি কিনে নেওয়া প্রোমোটার সংস্থা ‘ক্যানোপি প্রোজেক্ট’-এর দুই কর্তা লোকলস্কর নিয়ে সৌমিত্রবাবুর বাড়ি গিয়ে জানিয়ে এসেছেন, তিনি ভুল জমিতে বাড়ি তৈরি করেছেন। ওই সংস্থাটি সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ সরলা মাহেশ্বরীর স্বামী অরুণ মাহেশ্বরীর। অভিযোগ, বারবার চিঠি-ইমেল দিয়ে সৌমিত্রবাবুকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে, তিনি যেন জমি-বাড়ির দলিল ওই সংস্থার হাতে তুলে দেন। প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এর বদলে সৌমিত্রবাবুর ‘আসল’ জমির হদিশ খুঁজে দেবে ওই সংস্থা।
সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে শেখর রায় নামে আর এক ব্যক্তিকেও একই রকম তাগাদা দিয়ে চলেছে সংস্থাটি। একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী শেখরবাবু এখনও বাড়ি তৈরি করে উঠতে পারেননি। শুধু জমি ঘিরে পাঁচিল দিয়েছেন। সেই পাঁচিলের অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, লোহার গেট উধাও। সৌমিত্রবাবু ভয় পেয়ে সল্টলেকের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। জানিয়েছেন, ১৮ বছর আগে মহিষবাথানের ৪৯০ দাগ নম্বরের ৩২ নম্বর প্লট কেনেন তিনি। তখন ছিল ধানিজমি। আইনমাফিক তার চরিত্র বদলে বাস্তুজমি করা হয়। বারাসত ও রাজারহাটে বিএলআরও-র দফতরে দু’বার করে জমির হাত বদলের মিউটেশন হয়। তার পরে সেই সব নথি দেখে ১৯৯৭ সালের অগস্টে বাড়ির নকশা অনুমোদন করে বিধাননগর পুরসভা। আইনমাফিক বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়। বিদ্যুতের লাইন আসে। সর্বোপরি, বছর বছর বাড়ির করও জমা পড়ছে। |
তাঁর অভিযোগে সৌমিত্রবাবু জানিয়েছেন, গত অক্টোবরের প্রথম দিকে আচমকা এক দিন তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত হন পঙ্কজ পোদ্দার ও জয়কুমার দুজারি নামে দুই ব্যক্তি। তিনি বলেন, “ওই দুই ব্যক্তি ভিতরে ঢোকেন। আরও পাঁচ-ছ’জন বাইরে পাহারা দিচ্ছিলেন। তাঁরা এসে ভুল জমির কথা বললে আমি আকাশ থেকে পড়ি। তাঁরা জানান, এ জমির আসল মালিক তাঁদেরই সংস্থা। তাঁরা একটা বড় আবাসন কমপ্লেক্স তৈরির জন্য আশপাশের অনেক জমি কিনেছেন। আমার জমিটার জন্য কমপ্লেক্স তৈরিতে অসুবিধা হচ্ছে। তাঁরা নাকি নথিপত্র খুঁজে দেখেছেন যে, আমার জমিটাও তাঁরা কিনেছেন। আমি যেন তাঁদের হাতে আমার দলিল দিয়ে দিই। তাঁরাই আমার আসল জমি খুঁজে দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি দেন।” তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই ওই সংস্থা থেকে দলিল হস্তান্তর করার জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগে জানান সৌমিত্রবাবু।
ওই সংস্থাটির কর্তা পঙ্কজ পোদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে চাই বলেই সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু উনি দেখছি মিডিয়াকে জানিয়েছেন।” এর পরে কিছুটা তীক্ষ্ন সুরে বলেন, “ঠিক আছে, আদালতেই দেখা হবে।” কথায় কথায় তিনি এ-ও বলেন, “সরলাজির (সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ) পরিবারের সঙ্গে আমার কোম্পানির যোগাযোগ আছে। আমার মালিক এস কে হিম্মৎসিংকা ওই পরিবারের জামাই।” কিন্তু সেক্টর ফাইভে ক্যানোপি প্রোজেক্টের দফতর থেকে জানা গিয়েছে, হিম্মৎসিংকা এই সংস্থায় আছেন বটে, তবে এর প্রধান মালিক সরলা মাহেশ্বরীর স্বামী অরুণ মাহেশ্বরী ও জামাই অমিতাভ কেজরিওয়াল। অর্থাৎ, প্রাক্তন সাংসদের দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে আগে যেমন রাজারহাটের বিস্তীর্ণ এলাকার জমি দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল, সৌমিত্রবাবুদের জমি-বাড়িও হস্তগত করতে একই কৌশল গ্রহণ করছে ওই সংস্থা।
কী সেই কৌশল? সৌমিত্রবাবুরা সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স থানায় গত বছরের ৩০ অক্টোবর অভিযোগ দায়ের করলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি থানা। বদলে সৌমিত্রবাবুকে থানায় ডেকে পাঠিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে মীমাংসা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি পুলিশের পরামর্শ মানতে রাজি হননি। তখন ওই সংস্থা থেকে যোগাযোগ করা হয় বারাসত ও রাজারহাটের ব্লক ভূমি রাজস্ব দফতরে। এ নিয়ে রাজারহাট দফতরের তৎকালীন বিএলআরও আব্দুল মান্নানের সঙ্গে সৌমিত্রবাবুরা দেখা করলে তিনি জানান, সৌমিত্রবাবুরা সত্যিই ‘ভুল’ জমিতে আছেন। তবে অরুণ মাহেশ্বরী ও তাঁর এক জামাইকে সিআইডি গ্রেফতার করার পরে চিত্র বদলে গিয়েছে। নতুন বিএলআরও রবীন্দ্র ঘোষ বলেন, “কে কোথায় ভুল বা ঠিক জমিতে আছেন, তা দেখা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ নেই। একমাত্র আদালত আমাদের তদন্ত করতে বললে তবেই আমরা দেখতে পারি।” |