|
|
|
|
১৯ বছর পরে |
নীল ডায়েরি ফেরাল দুই ডানপিটেকে |
নিলয় দাস • ফালাকাটা |
‘মা ও বাবুজি, আমরা প্রাজাব আছি। আমাকে লে কে যাও। আমাদের পাতা ও মালিকের নাম গোদেব সিং মাস্টার, গ্রাম সিউড়িয়া, গুরুদাসপুর।’ চিঠির নীচে লেখা বিশ্বজিৎ।
গত ২৪ মে বিশ্বজিতের এই চিঠি পেয়ে চমকে যান ফালাকাটার ছোটশালকুমারের বাসিন্দা নৃপেন আচার্য। বিশ্বজিৎ তাঁর ছোট ছেলে। ১৯ বছর ধরে নিখোঁজ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন। কিন্তু পাননি। বিশ্বজিতের সঙ্গে পালিয়েছিল গ্রামের ছেলে গুরুদাস বর্মনও। সেই কবেকার কথা। তখন ১৯৯৩ সাল। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন নৃপেনবাবু। কিন্তু বাবার মন বলছিল, ছেলে ঠিকই বেঁচে আছে। আছে নিশ্চয় কোথাও। চিঠিটা পেয়ে একটা মৃদু লাফ মেরে নৃপেনবাবু তাই শুধু বলতে পেরেছিলেন, “বেঁচে আছে। আমার ছেলে বেঁচে আছে।” ভূমি রাজস্ব দফতরের অবসরপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নৃপেনবাবু বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। ছুটে যান ফালাকাটা থানায়। চিঠির সূত্র ধরে পঞ্জাবে গিয়ে উদ্ধার করে আনা হয় বিশ্বজিৎ ও গুরুদাসকে। দু’জনেই এখন ২৮ বছরের তরতাজা যুবক। দু’জনেই মাতৃভাষা প্রায় ভুলেছেন। কথা বলেন পঞ্জাবি ভাষায়। চিঠিতে পঞ্জাবকে লিখেছেন ‘প্রাজাব।’ বুধবার সকালে তাঁরা গ্রামে পৌঁছতেই প্রবল উত্তেজনা। গ্রামবাসীরা যেন জ্যান্ত সিনেমা দেখছেন। গোটা এলাকায় উৎসবের বাতাবরণ। |
|
বিশ্বজিৎ আচার্য ও গুরুদাস বর্মন। ছবি: রাজকুমার মোদক |
বিশ্বজিতের মা-বাবা সহ বড় দুই দাদা রয়েছে। আর গুরুদাসের ভাইবোন কেউ নেই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে সে পিসতুতো দাদার বাড়িতে থাকত। গ্রামবাসীরা জানান, ছোটবেলায় বিশ্বজিৎ আর গুরুদাস দিনভর এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়াত। পড়াশোনার থেকে বাগানের আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুর খবর রাখত বেশি। ভরদুপুরে দুই বন্ধু মিলে চুরি করত সেই সব ফল। নেমন্তন্ন থাকুক আর না থাকুক, নিজের গ্রাম আর পাশের গ্রামে কোথাও বিয়ে বা অন্নপ্রাশন হলে দু’জনে আগে সেখানে হাজির হত। মনটা ছিল সরল। আকাশ ওদের ডাকত।
১৯৯৩ সাল। বাড়ির বকাঝকা ও শিক্ষকের বেত দু’জনেরই আর ভাল লাগছিল না। ট্রেনের হুইসল দু’জনকেই খুব টানত। সেই টানেই আম-জামের বাগানকে পিছনে ফেলে সোজা ট্রেনে চেপে দিল্লি পাড়ি। হঠাৎই বেপাত্তা ছোটশালকুমারের ৯-১০ বছরের দুই ডানপিটে।
পুলিশ জানাচ্ছে, দিল্লিতে কিছুদিন এক ধাবাতে দু’জন কাজ করে। তার পরে এক ট্রাক চালকের সঙ্গে পৌঁছয় পঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলায়। গ্রামের দুই বাড়িতে তাদের ঠাঁই হয়। খেতের দেখভালের সঙ্গে ট্রাক্টর চালানো শিখে ফেলে দু’জন। ধীরে ধীরে তারা দুই কৃষক পরিবারের নয়নের মণি হয়ে ওঠে। বিশ্বজিৎ এবং গুরুদাস বাংলা ছেড়ে পঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। দু’জনেই ভুলে যায় বাড়ির কথা। শুধু মনে থাকে গ্রামের নামটি। ছোটশালকুমার। কেটে যায় বছরের পর বছর।
দিন কয়েক আগে ঘরদোর সাফ করতে গিয়ে নীলরঙের ডায়েরি নজরে পড়ে বিশ্বজিতের। এই ডায়েরিটা সে-ই নিয়ে এনেছিল ছোটশালকুমার থেকে। সেই ডায়েরিতে লেখা ছিল বাড়ির ঠিকানা। লেখা ছিল বাবার নামও। অতি কষ্টে সেগুলি পড়ে ফেলতেই বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে অকস্মাৎ। বাড়ির ঠিকানায় সে বাবাকে চিঠি লেখে আমাকে লে কে যাও।
বিশ্বজিতের কথায়, “সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম। ডায়েরিতে বাবার নাম দেখার পর মনটা হু হু করে ওঠে। শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। তাই বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লিখে ফেলি।” আর গুরুদাসের কথায়, “বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে পঞ্জাবে চলে গিয়েছিলাম। বহু বছর বাদে গ্রামে ফিরে ভাল লাগছে। গাছে কাঁঠালও পেকেছে দেখছি। এখানেই কোনও কাজ খুঁজে নেব।” বিশ্বজিতের বাবা নৃপেনবাবু ও গুরুদাসের পিসতুতো দাদা হরিপদবাবুর কথায়, “ওরা বাড়ি ছেড়ে পালানোর পর বহু খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাইনি। ওরা যে বাড়ি ফিরে আসবে, ভাবতেই পারিনি।” ফালাকাটা ধানার আইসি ফরিদ হোসেন বলেন, “দু’জনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পেরে আমরা খুশি।” খুশি ছোটশালকুমারের গাছগাছালিও। বহুদিন দুই বন্ধুর সঙ্গে ওদের দেখা নেই। |
|
|
|
|
|