এটা ঠিকই যে, বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সঙ্কট। এটাও ভুল নয় যে,
ভারতের ওপর
তার প্রভাব পড়ছে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক
সমস্যার
অনেকটাই, যাকে বলে, নিজকীর্তি। লিখছেন তপন ভৌমিক |
দেশের আর্থিক অবনতির কথা জনতার কাছে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন রাখে না। বিশেষজ্ঞরাও যেন বিভ্রান্ত। কবে এবং কী ভাবে বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে, কবে হারানো অবস্থা ফিরবে, হলফ করে কেউই বলতে পারছেন না। আমরা কেন এবং কী ভাবে এ অবস্থায় পৌঁছলাম?
প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, অন্যান্য রাজনীতিকদের, এমনকী সরকারি আমলাদের একটাই উত্তর। গোটা বিশ্বের আর্থিক অবস্থায় যে সংকট এবং বিশেষ করে ইউরো এলাকার দেশগুলোতে, আমাদের আর্থিক অবস্থা সেই জন্যই খারাপ হচ্ছে। আমাদের অর্থব্যবস্থা দ্রুত বিশ্বায়নের জন্য বিশ্বের অর্থব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত। আমাদের অর্থব্যবস্থা এমনিতে শক্তপোক্ত, কিন্তু কী করা যাবে যখন বিশ্ব অর্থব্যবস্থা, বিশেষ করে আমেরিকা-ইউরোপের সামনে কঠিন সমস্যা। অনেকে, অনেকটা না বুঝেই গ্রিসকে দায়ী করছে। কথাগুলো একেবারে অযৌক্তিক নয়, এর মধ্যে সত্য খানিকটা আছে। তবে কয়েকটা কথা বলা দরকার এই প্রসঙ্গে।
ঠিক, সমগ্র বিশ্বের অর্থব্যবস্থা অনিশ্চয়তার মুখে। কিন্তু সামগ্রিক বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় সম্মিলিত জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিতে যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, আমাদের জাতীয় আয়ের গতিবৃদ্ধির ঘাটতি হচ্ছে অনেক বেশি হারে। উদারীকরণের যুগে (১৯৯১-২০১১) আমাদের জাতীয় আয় গড়পড়তা হিসাবে বেড়েছে মাত্র ৬.৯ শতাংশ হারে, যেখানে চিনে এই সময়ে বৃদ্ধির মাত্রা ছিল ১০.৫ শতাংশ। বিশ্বায়ন তথা উদারীকরণের যুগে অর্থব্যবস্থায় গতিবৃদ্ধি তেমন দ্রুত হারে হয়নি। |
প্রতিবাদ। ৩১ মে, পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ডাকা ভারত বন্ধ-এর দিন
ইলাহাবাদে প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ। ছবি: পি টি আই |
কিন্তু অর্থব্যবস্থায় দ্রুত হারের গতি দেখা গিয়েছিল তিন বছর ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭ এবং ২০০৭-০৮-এ, যখন জাতীয় আয়ে গড়পড়তা বার্ষিক ৯.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু তার পর আমেরিকায় আসে চরম সংকট, যা চরমে পৌঁছেছিল ২০০৮-এ। বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অর্থব্যবস্থাতেও এসেছিল সংকট, ভয়াবহ ভাবে। সেটা ইউপিএ সরকারের প্রথম পর্যায়। সরকার সেই সংকট মোটামুটি ভাল ভাবেই সামাল দিয়েছিল। যা করণীয় ছিল, তা করতে পেরেছিল। তার অন্যতম কারণ, সরকারের দলগুলো বিশেষ অসুবিধা করেনি। তর্কাতর্কি অনেক হত, কিন্তু তা ছিল যুক্তিপূর্ণ। ইউপিএ-১ দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ধ্বংসাত্মক মনোভাব ছিল না।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট এবং বিশেষ করে ইউরোপের সংকট আমাদের অর্থব্যবস্থাকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। গত আর্থিক বছরে (২০১১-১২) জাতীয় আয়ে বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬.৫ শতাংশ, শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি নেমেছে ২.৮ শতাংশে। ২০১২ মার্চ মাসে উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে ৩.৫ শতাংশ। বর্তমান আর্থিক বছরে জাতীয় আয়ে বৃদ্ধি আরও কম হওয়ার সম্ভাবনা। এ সব বৃত্তান্ত জানা। সোজা কথায় আসা যাক।
বর্তমান আর্থিক সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ অভ্যন্তরীণ। কংগ্রেস চালিত ইউপিএ-২ সরকার নিষ্ক্রিয়তায় ভুগছেন। করণীয় কিছুই করতে পারছেন না এবং সাহসও পাচ্ছেন না। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যে কতটা শোচনীয়, তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। সামগ্রিক ভাবে রাহু-কেতুর দখলে রয়েছে অর্থব্যবস্থা। ‘আন্ধের নগরী, চৌপট রাজা’ কথাটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। বর্তমান সরকারের আমলে দেশ জুড়ে যা চলেছে, তা যেন ‘আন্ধের নগরী’-র মতো। কিন্তু রাজা অর্থাৎ সরকারকে যেন প্রস্তরবৎ স্থবির করে রাখা হয়েছে। কমনওয়েলথ গেমসের পর থেকে অণ্ণা হাজারে ও তাঁর মুষ্টিমেয় দলবল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করেছে, তার পর থেকে কংগ্রেস ভীতসন্ত্রস্ত। একদম মুখ খুলছে না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে যা ঘটছে, সেটা বিশেষ এবং সাময়িক বলে ধরে নেওয়াই ভাল।
কংগ্রেসের নেতৃত্বে তৈরি এই সরকার স্বভাবতই একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। সব থেকে বড় কথা, ইউ পিএ-২ সরকারের শরিক আঞ্চলিক দলগুলো সরকারকে কিছুই করতে দিচ্ছে না। বর্তমান অর্থব্যবস্থা এমন কিছু খারাপ নয় যে গেল-গেল রব তুলতে হবে। কিন্তু সরকারকে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে, কিছু আর্থিক সংস্কারের কাজে হাত দিতে হবে। কিন্তু তাতে প্রধান বাধা আঞ্চলিক দলগুলো, যারা সরকারের অন্তর্ভুক্ত বা সমর্থক। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে শোষণ করে টাকা আদায়।
বলা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার হাইজ্যাক্ড। দেশ ও তার শাসনব্যবস্থায় যেন সরকারের আর কোনও হাত নেই। শাসনব্যবস্থায় বিচারব্যবস্থার তত্ত্বাবধান ও রায়ের হস্তক্ষেপের মাত্রা সম্পূর্ণ। অন্য দিকে, সরকারকে ক্রমান্বয়ে পর্যুদস্ত করে চলেছে সিএজি নামে ওয়াচডগ।
প্রস্তরমূর্তি যারই হোক না কেন, ইচ্ছা করলেই থাপ্পড়টা-চড়টা মেরে আসতে পারি, মূর্তি তেমনই হাসি মুখে থাকবে। ফলে যার যা খুশি করে যাচ্ছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় বিঘ্ন নেই। ভাবটা যেন এই, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর, বোবার শত্রু নেই।
এই সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু ঠিকই বলেছিলেন যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনও সম্ভাবনা নাই। যেমন চলছে তেমনই চলবে। তবে কি, তার আগে অর্থব্যবস্থায় উন্নতির কোনও আশা নেই? বর্তমান বা আগামী আর্থিক বছরে? আমি বলব, আশা খুবই ক্ষীণ।
|
দিল্লিতে একটি বেসরকারি সংস্থার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা |