সাক্ষাৎকার...
মুক্তমন আছে বললেই হবে না, তার চর্চাও প্রয়োজন
মার্কিনরা কেমন হয়, ঠিকঠাক বললে ‘প্রকৃত’ মার্কিনরা কেমন হয়, তা দেখাতেই তাঁর কলকাতায় আগমন। একক অভিনয়ে তাঁর রঙ্গনাট্যের নাম ‘দ্য রিয়াল আমেরিকানস’। সেই নাটক নিয়ে বহু দেশ ঘুরেছেন তিনি। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে ঘোরেননি। যেখানে গিয়েছেন, ঘুরে ঘুরে বুঝতে চেয়েছেন সেই এলাকার চালচিত্র। তিনি নাট্যকার, অভিনেতা তো বটেই, সাংবাদিকও।
ড্যান হয়েল।
ঠিক যেমন, কলকাতায় এসে তিনি হোটেলেই থাকেননি, নগরীর দক্ষিণতম প্রান্তে একটি ঘর ভাড়া করে ছিলেন, তার পর, ট্রামে, বাসে, মেট্রোয় চষেছেন শহর। তাঁর সঙ্গে আলাপের মধ্যেই বললাম, যাক, বোঝা গেল র‌্যাম্বো ছাড়াও ধরাধামে আরও কিছু আসল মার্কিন আছেন!
ড্যান হাসলেন না, বললেন, দুঃখিত, আমি র‌্যাম্বোর কোনও ছবি দেখিনি। আর, কী করেই বা বোঝা গেল, র‌্যাম্বোই প্রকৃত মার্কিন?
কেন? সে তো হলিউডই আমাদের বুঝিয়েছে। এমনিতে শান্ত, কিন্তু আঘাত করলে ভয়ঙ্কর। অন্য দিকে, অসহায়ের পরিত্রাতা! পেশিবহুল হাতে বিশাল মেশিনগান। র‌্যাম্বো।
এই ধরনের ছবির বাজারটা বুঝতে পারছি, কিন্তু এ সব ছাড়াও হলিউড আছে। আমি স্পেন-এ বেশ কিছুকাল ছিলাম। সেখানে কিন্তু এ সব র‌্যাম্বো-ট্যাম্বো নিয়ে মাতামাতি দেখিনি। হলিউড এই ধরনের ছবি বানায়, ঠিকই, কিন্তু সে সব যায়ই না সেখানে।
বললাম, যদি র‌্যাম্বো ছেড়েও দেন, তা হলেও কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মার্কিনের পরিত্রাতা ভাবমূর্তিটা টোল খায় না। হলিউডের প্রচুর ব্লকবাস্টার ছবিতে একের পর এক সেই চেহারা। প্রকৃত মার্কিন! আপনি কি সেই স্টিরিওটাইপটাকেই ভাঙতে চান?
ড্যান বললেন, বছর চারেক আগে, ২০০৮-এ, সারা পালিন, তখন আলাস্কার গভর্নর, নর্থ ক্যারোলাইনায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, গ্রামগঞ্জেই নাকি আসল আমেরিকা হাজির। সেই মন্তব্য ঘিরে বিরাট বিতর্ক হল। তো, সেটা থেকেই আমি ভাবতে শুরু করি, এই আসল মার্কিনটিকে খুঁজলে কেমন হয়? কী করে সে, কী খায়, কী চায়, কী ভাবে থাকে?
সেই ভাবনাটুকুই ড্যান হয়েল-এর রঙ্গনাটক ‘দ্য রিয়াল আমেরিকানস’-এর বীজ।
বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কার্টুন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে, এমনকী জাতীয় স্তরেও কথাবার্তা হচ্ছে, বিতর্ক হচ্ছে!
ড্যান বললেন, আমি এ দেশে আছি মাত্রই কয়েক সপ্তাহ, বিষয়টা ততটা ভাল জানি না যে যার জোরে কোনও মন্তব্য করা যায়!
কার্টুন নিয়ে ঠিক কী হয়েছে, তা কতটা ঠিক বা ভুল, এ সব নিয়ে কিছু জানতে চাইছি না, প্রশ্নটা এই যে, কার্টুন মানে অন্য ভাবে দেখা! তির্যক ভাবে দেখা। লেখক এবং পারফর্মার হিসাবে সেটা আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, আপনিও আপনার বিভিন্ন নাটকে সমকালীন নানা বিষয়ে ‘কমেন্ট’ করেন!
ড্যান এক লহমা সময় নিলেন। বললেন, এখানে কী হয়েছে, তা নিয়ে কিছু বলব না। সাধারণ ভাবে বলতে পারি, শিল্পী হিসাবে আমি বিশ্বে কী ঘটছে, তাকে আমার কাজে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সময়ের একটা ছাপ ধরতে চেষ্টা করি। সেই সূত্রেই মনে হয়, ভাবনার একটা খোলা দেওয়া-নেওয়া খুব জরুরি।
কোথাও সেই দেওয়া-নেওয়াটা কি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
উঁহু, যা ভাল ভাবে জানি না, তা নিয়ে মন্তব্য করব না। তবে, এইটুকু বলতেই পারি যে, কলকাতায় আমি যে জিনিসটা দেখে সব থেকে বিস্মিত হয়েছি, তা হল এই ‘ফ্রি এক্সচেঞ্জ অব আইডিয়াস’, ভাবনার আদান-প্রদান। এমন নয় যে সমাজে যে যার নিজের শ্রেণির মধ্যে, নিজস্ব বলয়ের মধ্যে কথা-চালাচালি করল। বরং উল্টো। বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে এই কথাবার্তাটা চলে। কারণ, লোকে এটা চায়। পছন্দ করে। আমাকে বলেওছে সে কথা।
বিষয়টাকে একটু অন্য দিক থেকে দেখলে, কার্টুন যিনি আঁকছেন, রঙ্গব্যঙ্গ যিনি করছেন, তাঁরও তো একটা দায়িত্ব আছে।
অবশ্যই আছে। লোকজন, স্বাভাবিক ভাবেই স্পর্শকাতর। পৃথিবী জুড়েই তাই।
কতটা স্পর্শকাতর?
আপনি কি এখানকার সঙ্গে কোনও তুলনা টানতে চাইছেন? তা হলে বলব, আমি সেটা করতে অপারগ। তা ছাড়া, কী হলে কী হয়, সেই ধরনের কোনও কথায় ঢুকতে চাই না।
বাদ দিন। অন্তত, এইটুকু বলুন যে আপনিও তো প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নিয়ে এসেছেন আপনার এই ‘দ্য রিয়াল আমেরিকানস’-এর মধ্যে? ভয় করেনি?
না, ভয় করবে কেন? আমি সব সময় একটা নৈতিক মান বজায় রাখার চেষ্টা করি, যাকে বলে একটা স্ট্যান্ডার্ড অব এথিকস।
সেটা কী?
সেটা এই যে যা আমি দেখাচ্ছি, এবং যে ভাবে দেখাচ্ছি, সেটা কতখানি বাস্তবসম্মত। আমার কাজের পিছনে যুক্তিটা আমার নিজের কাছে স্পষ্ট না অস্পষ্ট। বিষয়টার সংবেদনশীলতা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে, খুব জরুরি একটা ভারসাম্যের খেলা আছে। এক দিকে, সেন্স অব রিয়ালিটি। অন্য দিকে, সেন্স অব হিউমার। প্রায়ই দেখা যায়, একটা বেড়ে গিয়ে অন্যটাকে গ্রাস করে নেয়। সেটা যাতে না হয়, সেটা দেখাই শিল্পীর কাজ। কারণ, এই ভারসাম্যটাই শিল্প।
এই ভারসাম্যটা তাঁর পক্ষে আরও জরুরি, যিনি সমকালীন নানা বিষয় নিজস্ব তির্যক দৃষ্টিকোণ থেকে হাজির করছেন।
ঠিক। আমি মনে করি, পৃথিবীতে কী ঘটছে, তা নিয়ে ভাবা, সে বিষয়ে মন্তব্য করা শিল্পীর দায়িত্ব। খুব জোরালো ভাবে, সংবেদনশীল ভাবে আর অবশ্যই হিউমার-টা বজায় রেখে, ইফ হিউমার হেল্পস আস টু মুভ ফরওয়ার্ড।
ক্ষমা করবেন, কিন্তু এই ‘মুভ ফরওয়ার্ড’ বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?
বলতে চাইছি, নিজের কথাটা বলা, টু স্পিক ট্রুথ টু পাওয়ার, ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথাটা জানিয়ে দেওয়া।
সেই কাজটা যে কঠিন, তা আমরা সবাই জানি। আপনার কাছে জানতে চাইছি, কেন কঠিন? কয়েকটা ব্যাখ্যা খুব চেনা। সত্য অপ্রিয় হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, আপনি জিনিসটাকে কী ভাবে দেখেন?
আমি আমার কাজের কথা বলতে পারি, অন্য কিছু নয়। যখন বাস্তব দুনিয়ার কিছু মানুষ আপনার কাজকর্মের বিষয় হয়ে উঠছেন, তখন ওই নীতির ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দু’ভাবে। এক, আমি অন্যখানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের নাটক তৈরি করি। ফলে, যাঁরা আমাকে নিজেদের কথা, অভিজ্ঞতা এই সব বলছেন, তাঁদের সম্মান করাটা জরুরি। দুই, গোটা বিষয়টার মধ্যে একটা স্বচ্ছতা বজায় রাখা দরকার। সেটা শক্ত কাজও বটে। যদি ধরেই নিই যে এই কথাটা আমাকে বলতে হবে, এবং তার জন্যে যা করা দরকার, তা করব, তা হলে জিনিসটা একপেশে হয়ে যেতে পারে।
কী করণীয়?
ওই যে বললাম, একটা স্বচ্ছতা বজায় রাখা। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সেটা কিন্তু লোকে পছন্দও করে। দর্শককে বিশেষ কোনও সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে হবে না, তার দরকারও নেই, বরং তাঁকে ভাবতে বলুন, তিনি যাতে নিজের একটা মতামত গড়ে তুলতে পারেন, সেই চেষ্টা করুন। তাঁর সামনে তুলে ধরুন, কী ঘটছে, কী ঘটেছে। সেটাই রঙ্গ-কর্মীর কাজ। বিশেষ করে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তো এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি নাগরিক, আমি ভোট দিই, সরকার নির্বাচনে আমার একটা ভূমিকা আছে, ফলে এটা জানা আমার পক্ষে খুবই জরুরি যে আমার শহরে, আমার দেশে এবং পৃথিবীতে কী ঘটছে। নাগরিক হিসাবে এটা আমার দায়িত্বও বটে।
এই সূত্রেই কি ভাবনার ওই খোলা দেওয়া-নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ?
এই সূত্রেই। আমি লক্ষ করেছি, কলকাতার মধ্যে একটা ‘নিউজ কালচার’ আছে। এটা শহরের গণ-সংস্কৃতির মধ্যেই আছে। লোকে কথা বলছে, রীতিমতো রাজনীতি নিয়ে, নেতাটেতাদের নিয়ে তর্ক করছে, ঘরের মধ্যে না, পাবলিক স্পেস-এ করছে, এই জিনিসটা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
শুনেছি, কলকাতার রাস্তার ধারে অজস্র চায়ের দোকান দেখে আপনি খুব মুগ্ধ! সেটা কি এই কারণে যে ওই ‘পাবলিক স্পেস’টা আপনাকে টেনেছে?
ড্যান চকিতে হাসলেন, চা-টাও ভাল, কিন্তু আমি দেখেছি, লোকে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় না। তারা বোঝে যে আপনি এটা নিয়ে কথা বলতে পারেন, কারও সঙ্গে ভিন্নমত হতেই পারেন এবং তা সত্ত্বেও তার বন্ধু থাকতে পারেন। এটা জরুরি। এই ধরনের স্পেস থাকাটাও জরুরি। কলকাতায় এই ধরনের পাবলিক স্পেস প্রচুর।
বললাম, একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দু’ধরনের মানুষ খবরের কাগজ পড়েন।
, যাঁরা নিজেদের বিশ্বাসের সমর্থন চান।
, যাঁরা নিজস্ব ভাবনার বিরুদ্ধ মতটা শুনতে চান।
ড্যান হয়েল স্বয়ং পারফর্মার, ফলে সর্বদা সপ্রতিভ, কিন্তু এই বার এক মুহূর্ত থেমে বললেন, দায়িত্বটা কী জানেন? আপনি যে মুক্তমনা হবেন, সেটা শুধু ভাবলেই হল না। এটা চর্চার জিনিস। রোজ, একেবারে প্রতিটি দিন এটার চর্চা করতে হয়। কবে একটা বিতর্ক হবে, আর আমি একটা অবস্থান নেব, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। নিজে যে মতটা আঁকড়ে আছেন, যা ভাবলে স্বস্তিবোধ করেন, সেই আরামটা ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। তা হলে আপনি অন্যের মতটা বুঝতে পারবেন, একমত হতে না-ই পারেন, কিন্তু যুক্তিটা ধরতে পারবেন। সেটা জরুরি। সেটাই জরুরি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.