গত মাসে রাজ্যসভায় একটি খসড়া আইন পেশ করা হইয়াছে। এক সাংসদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাহা করিয়াছেন। সাংসদ ভারতে ‘সবুজ বিপ্লবের’ রূপকার এম এস স্বামীনাথন। তাঁহার প্রস্তাবটি বলিতেছে, যে কোনও মহিলা তাঁহার বিবাহের পর স্বামীর কৃষিজমির অর্ধেক মালিকানা পাইবেন। উত্তরাধিকার সূত্রে, নিজে ক্রয় করিয়া অথবা সরকারি অনুদানে প্রাপ্ত জমি, মহিলার অর্ধ-মালিকানা সকল ক্ষেত্রেই বহাল থাকিবে। যে কোনও মহিলা তাঁহার স্বামীর মতোই কিষান ক্রেডিট কার্ড পাইবেন, কৃষিঋণ, সেচের জল, কৃষি সমবায়ে সদস্যপদ, বিপণনের সুবিধা ইত্যাদি পাইবেন। উপরন্তু মহিলা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা লইবে এবং মহিলা কৃষকদের সমবায় বা ‘মহিলা কিষান কেন্দ্র’ খুলিবে, এমনই প্রস্তাব করিয়াছে এই আইনটি।
এই আইনটি দীর্ঘ দিনের একটি সমস্যার সমাধান করিবার উদ্যোগ লইয়াছে। এ দেশে মহিলারা যদিও কৃষির কাজের অর্ধেক, কিংবা তাহারও অধিক করিয়া থাকে, কিন্তু কৃষক রূপে পূর্ণ স্বীকৃতি তাঁহারা কখনও পান নাই। চাষি বলিতেই ‘চাষিভাই’ বোঝা হয়, চাষিবউ কিংবা চাষিবোন আড়ালেই রহিয়া গেল। তাহার প্রধান কারণ, মহিলাদের কৃষিজমির উপর অধিকার নাই। বাপের বাড়িতে তাহার অধিকার কেবল বাস্তুভিটার উপর, স্বামীর বাড়িতে কৃষিজমি যৌথসম্পত্তি হওয়ায় প্রায়ই মহিলাদের কোনও পৃথক ভাগ নাই, জমির দলিলে মহিলাদের নাম পাওয়া অতি বিরল ঘটনা। পরিবারের জমিতে মহিলারা প্রচুর পরিশ্রমে শস্য কিংবা সবজি ফলাইলেও তাঁহাদের শ্রমের কোনও স্বীকৃতি নাই, এমনকী তাঁহার পরিবার তাঁহার জন্য যথেষ্ট খাদ্যও বরাদ্দ না করিতে পারে। এ দেশে মহিলাদের মধ্যে বিপুল অপুষ্টি এবং রক্তহীনতা তাহারই ইঙ্গিত দেয়। সমাজে এবং অর্থনীতিতে মেয়েদের মর্যাদার স্থান পাইতে হইলে তাঁহাদের জমির মালিকানা যে প্রয়োজন, তাহা দীর্ঘ দিন ধরিয়া নারীবাদী অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ আন্দোলনকারীরা দাবি করিয়া আসিতেছেন। অতএব ইহা আক্ষেপের বিষয় যে, মহিলা কৃষকদের অধিকার-সংক্রান্ত এই বিলটি ব্যক্তিগত বিল হিসাবে পেশ হইল। এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে এটি পেশ হইলেই শোভন হইত।
তবে প্রস্তাবিত আইনটি কেবল এই ঐতিহাসিক ত্রুটির নিরসন করিতে চাহিয়াছে, এমন নহে। একবিংশ শতকের বাস্তব পরিস্থিতি ও তাহার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রাখিয়াই ইহা নির্মিত। কৃষি অ-লাভজনক হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে অভিনবত্ব, পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগও সীমিত। ফলে ভারতের যুব সমাজের একটি বড় অংশ কৃষিতে উৎসাহ হারাইয়া শহরে কাজের খোঁজে আসিতেছে। ফলে গ্রামগুলিতে যাঁহারা কৃষির মূল কাজগুলি করিতেছেন, তাঁহারা মহিলা। অথচ তাঁহাদের জমির মালিকানা নাই, সমবায়ের সদস্যপদ নাই, এই সকল কারণে ঋণগ্রহণ এবং উৎপাদনের বিপণনের বিষয়ে তাঁহাদের পরনির্ভর থাকিতে হইতেছে। নিজস্ব উদ্যোগ লইবার উপায় তাঁহাদের সীমিত। এই অচলাবস্থা কাটাইতে পারে প্রস্তাবিত আইন। এক সময়ে ভূমিসংস্কার এবং ভাগচাষিদের স্বীকৃতি যে ভাবে কৃষিতে নূতন গতি আনিয়াছিল, সেই ভাবে মহিলাদের জমির মালিকানা ও শ্রমের স্বীকৃতিও কৃষিকে সমৃদ্ধ করিতে পারে। উপরন্তু, মহিলারা গোষ্ঠীবদ্ধ হইয়া কাজ করিতে অধিক সফল, তাহা প্রমাণিত। অতএব মহিলা কৃষি সমবায়গুলি উৎপাদন ও বিপণনে নূতন মোড় আনিতে পারে। এই সকল সম্ভাবনা বাস্তব করিতে হইলে সংসদকে এই বিলটি গুরুত্বের সহিত গ্রহণ করিতে হইবে। |