এক দিকে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে শাসক দলের আপত্তির ইতিহাস, অন্য দিকে শিল্পনীতি সম্পর্কে
সুস্পষ্ট এবং কার্যকর নীতির অভাব, দুইয়ে মিলে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা বিরাট। লিখছেন সুপর্ণ পাঠক |
জমি বিল নাকি বিধানসভার এই অধিবেশনেও পেশ করা হবে না। সরকারি ব্যাখ্যা নেই, তবে মনে করা হচ্ছে, এই বিল আরও পরিমার্জিত হবে। অথবা, হয়তো, কেন্দ্রের জমি বিলের অপেক্ষা, যাতে রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের আইনের দ্বন্দ্ব না থাকে। কেন দেরি, তা কেউ স্পষ্ট জানে না। কারণ রাজ্য সরকার তা জানাচ্ছে না। জানাচ্ছে না বলেই কারণ অনুমানের জায়গা তৈরি হচ্ছে, হয়েই চলেছে।
এ রাজ্যে বিনিয়োগে আগ্রহী যে কোনও সংস্থার কাছে এটাই অন্যতম সমস্যা। সমস্যাটা রাজ্য সরকারের জমি বিল পরিমার্জনের ইচ্ছা নিয়ে নয়, সমস্যা কেন্দ্রের জমি বিলের জন্য অপেক্ষা করা নিয়েও নয়। সমস্যা রাজ্য সরকারের শিল্পনীতির ওই ‘হয়তো’এবং ‘অথবা’ নিয়েই।
শুনতে খানিকটা হযবরল-র গেছোদাদার হদিশের মতো লাগতে পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি নিয়ে শিল্পসংস্থাগুলি যে ঝুঁকির আশঙ্কায় গুটিয়ে আছে, তা রাজ্যের নীতির ব্যাপারে এই অস্বচ্ছতার কারণেই। তারা বুঝতে পারছে না, রাজ্য সরকার কী চাইছে। আর সরকার কী চাইছে তা বুঝতে না পারলে উদ্যোগীরা তো শিল্প বিনিয়োগ নিয়ে ভাবনার জায়গাতেই এগোতে পারবেন না, কারখানা তৈরি করা তো দূরস্থান। কারণ, সরকারের নীতি হয়তো এ রকম, এই ভেবে টাকা ঢেলে তার পরে যদি দেখা যায় যে না, সরকার আসলে ঠিক উল্টোটাই চাইছে তখন তো বিনিয়োগটাই জলে!
তাই তাঁদের প্রশ্ন, ‘এক বছর হয়তো অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে প্রশাসন শেখার জন্য কম সময়, কিন্তু নীতিটা কী, সেটা জনসমক্ষে পেশ করার মতো অভিজ্ঞতা তো এঁদের আছে। এক জন প্রাক্তন মুখ্যসচিব যাঁদের মন্ত্রী, শিল্পজগতের মনের অন্দরমহল নিয়ে খবর রাখা মানুষ যাঁদের মন্ত্রী, তাঁদের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে প্রশাসনিক নীতির মোড়কে বেঁধে ফেলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটা তো তখনই সমস্যা হবে যখন তাঁরা নিজেদের ইচ্ছাটা নিয়ে নিজেরাই সংশয়ে থাকবেন।’
তা হলে কি রাজ্য সরকার তাদের ইচ্ছেটা নিয়ে সত্যিই সমস্যায়? শিল্পমহল অন্তত ধন্দে। সমস্যাটা বুঝতে শুরু করা যাক শুরু দিয়েই। অর্থাৎ সেই সিঙ্গুর থেকেই।
সিঙ্গুর আন্দোলনে তৃণমূল কংগ্রেসের মূল স্লোগান ছিল, অনিচ্ছুক কৃষকের জমি ফেরত দিতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি ছিল প্রায় হাজার একর জমি দেওয়া হয়েছে টাটা মোটরসকে। তার মধ্যে ৪০০ একরের মতো জমি নেওয়া হয়েছে সেই সব কৃষকের কাছ থেকে যাঁরা জমি দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর অভিযোগ ছিল, সরকার রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের কাছ থেকে তাঁদের রুজির উৎস কেড়ে শিল্পের লাভের জায়গা করে দিচ্ছে।
সিঙ্গুরের এই স্লোগানের পরে রাজনৈতিক দল হিসাবে সরকারি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধ অবস্থান নিতে হবে ভোটের আগে ইস্তাহারে সেটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। এই স্লোগানের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতেই সম্ভবত সরকারে আসার পরে টাটাদের হাত থেকে সিঙ্গুরের জমি উদ্ধারের জন্য রাতারাতি আলাদা আইনও করে ফেলে তৃণমূল জোট। তার বিরুদ্ধে মামলা এখন আদালতে।
এই জমির প্রশ্ন যদি তৃণমূলের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে প্রসারিত করে থাকে, তা হলে কিন্তু সেটা শিল্পের মনেও এক ধন্ধের জায়গা তৈরি করে দেয়। কিছুটা সরলীকরণের দায় নিয়েই বলা যায়, সরকার শিল্পমহলের কাছে কিছুটা বিমাতা হয়ে ওঠে। তাদের ভাবনাটা দাঁড়ায় এ রকম— কৃষিকে ধরে ক্ষমতায় এসেছে যে সরকার, নিজেদের লাভক্ষতির অঙ্ক কষে সে শিল্পকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দেবে?
এই ভাবনা যে ভিত্তিহীন তা-ও বলা যায় না। কারণ, বাম জমানার বড় অংশই কেটেছে রাজ্যের হাতে শিল্পের দমন এবং গ্রামের পালনে। এই দুইয়ের মধ্যে যে সামঞ্জস্য সাধন জরুরি সেই বোধ জাগতে জাগতেই তাদের রাজত্ব শেষ অঙ্কে পৌঁছে যায়। তাই তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে শিল্পজগতের সংশয়ের জমি ইতিহাসই তৈরি করে দিয়েছে, এটা মানতে খুব বড় বিতর্কের প্রয়োজন নেই বোধহয়।
এই সংশয় গত এক বছরে ক্রমাগত গভীর হয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থানের জায়গা থেকে জমি যখন সরকার অধিগ্রহণ করে দেবে না, তখন যুক্তির সূত্রেই শিল্পকে নিজের জমি নিজেকে কিনে নিতে হবে। যথেষ্ট পরিমাপের প্রয়োজনীয় জমি শিল্পের পক্ষে কেনা সম্ভব কি না, অথবা সেখানেও জমির মালিকদের বঞ্চনার আশঙ্কা দেখা দেবে কি না তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। শিল্পমহল তার মধ্যে না ঢুকে প্রয়োগের ব্যাপারেই প্রশাসনের সামনে একটা প্রশ্ন তুলে ধরেছে। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, শিল্পের জন্য শর্তসাপেক্ষে জমি কিনলে সরকার তার পথে কাঁটা হবে না। কিন্তু শর্তটাকেই শিল্প ঝুঁকি বা কাঁটা হিসেবে দেখছে। প্রশাসন বলছে, বিনিয়োগে ইচ্ছুক সংস্থা জমি কেনার আগে জানাবে যে তারা কতটা জমি কিনবে এবং কী শিল্প গড়বে, প্রশাসন তাতে সবুজ বাতি দেখালে জমি কিনতে শুরু করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে তার পরেই সেই সংস্থা কারখানা গড়তে শুরু করতে পারবে না। তাকে আবার প্রশাসনের কাছে ফিরতে হবে, ওই জমিতে এ বার বিনিয়োগ শুরু করা যাবে কি না সেই প্রশ্ন নিয়ে। শিল্পের বক্তব্য, জমি কেনার পরে অনুমতি নিতে হবে, এর মানে হল, অনুমতি না পাওয়ারও সম্ভাবনা থাকা। বিনিয়োগকারী তা হলে জমি জোগাড়ের এই ঝামেলায় নামবেন কেন? ‘বেঙ্গল লিডস: ফোকাস ওয়েস্ট বেঙ্গল’ আলোচনায় শিল্পমহল চেয়েছিল জমি নীতি নিয়ে এই শর্ত ও তার প্রয়োগের স্পষ্ট ব্যাখ্যা। তাদের জিজ্ঞাসা ছিল, কেন এই দু’দফা অনুমতির ব্যবস্থা করে রাজ্যে বিনিয়োগকে ঝুঁকির অঙ্কে আরও কঠিন করে তোলা হচ্ছে? এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, সত্তরের দশক থেকে শুরু করে এই ২০১২ সাল পর্যন্ত কোনও সরকার বিনিয়োগের গন্তব্য হিসাবে রাজ্যকে তুলে ধরতে পারল না, নানান মনোহারী নামের শিল্পবৈঠক সত্ত্বেও। কারণ তো একটাই। দাবি আর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব। দাবি করছি, বিনিয়োগ করলে সরকার বিনিয়োগকারীকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করবে না। এই বিশ্বাসে এগিয়ে তার পর যদি কেউ দেখে যে, শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কেনার ব্যাপারে নতুন আইনে যে শর্ত আছে তা কতটা বিনিয়োগমুখী, প্রশাসন তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ, তা হলে তো তার মনে প্রশাসনের শিল্পমুখিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
ঠিক এই প্রশ্নের জায়গা থেকেই ফোর্ড ইন্ডিয়া বেছে নিয়েছে গুজরাতকে। কোম্পানির শীর্ষকর্তা মাইকেল বোনহম যে উক্তি করেছেন, সেটাই আজ বিনিয়োগ টানতে গুজরাত শিল্পোন্নয়ন নিগমের বিজ্ঞাপনের কাজ দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘রাজনৈতিক আন্দোলন যে ভাবে অন্য জায়গায় শিল্প প্রকল্পকে নষ্ট করেছে, গুজরাতে সে ঝুঁকি নেই।’ তিনি বলেছেন, গুজরাত ‘বিজনেসলাইক’। বোনহম-এর মতো মানুষের মন থেকে রাজ্য সম্পর্কে এই কালো ছায়া সরাতে শুরু করার জন্য এক বছর কিন্তু অনেকটা সময়। এমনকী ‘অনভিজ্ঞ’ প্রশাসনের পক্ষেও। আবার এই সময়টা কিন্তু মন্দার বাজারেও লগ্নি-শত্রু হিসাবে নিজেদের প্রতিপন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট। শিল্প কি রাজ্যকে সেই সেই ভাবেই দেখছে? দুঃখের ব্যাপার, এই প্রশ্নে স্পষ্ট ‘না’ বলার বদলে যে উত্তরটা উঠে আসছে তা হল ‘হয়তো’। |