যে সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে শ্যামল সেন কমিটি সুপারিশ করেছে, তাতে তথ্যগত ত্রুটি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ফের একটি কমিটি গড়ল রাজ্য। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আর্জির প্রেক্ষিতেই ওই তিন সদস্যের কমিটি গড়া হচ্ছে। চেয়ারম্যান হবেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের বিশেষ সচিব মনোজ অগ্রবাল। অন্য দু’টি নাম চূড়ান্ত হয়নি।
শনিবার মহাকরণে মোর্চার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের পরে ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শ্যামল সেন কমিটির ‘অবমাননাকর’ ও ‘একপেশে’ রিপোর্ট খারিজের দাবি জানিয়েছি। সরকার একটি তথ্য যাচাই কমিটি তৈরির কথা জানিয়েছে।”
রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের বক্তব্য, “তথ্য যাচাই কমিটি গঠনের ফলে শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্ট খারিজ হচ্ছে না। দুই কমিটির রিপোর্টে কোথাও ফারাক ধরা পড়লে, সরকার দেখবে তার নিষ্পত্তি কী ভাবে করা যায়।” ইতিমধ্যে, জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ) নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে রাজ্য। মোর্চাও আপত্তি করেনি। তবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কটাক্ষ, “রাস্তাঘাটে দেখি, বিজ্ঞাপন ‘পাহাড় হাসছে’। অর্থাৎ, পাহাড় সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে! তা হলে পাহাড় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক করার কী আছে?” |
প্রশ্ন হল, কেন দ্বিতীয় কমিটি গড়ার আর্জি মানল রাজ্য সরকার?
শ্যামল সেন কমিটি দার্জিলিং, জলপাইগুড়ির পাঁচটি মৌজা জিটিএ এলাকায় সংযোজনের সুপারিশ করেছিল। কমিটির সুপারিশ খারিজের দাবি তুললেও মোর্চা কিন্তু জনজীবন স্তব্ধ করার মতো আন্দোলনে নামেনি। মোর্চার অন্দরের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তা উল্লেখও করা হয়েছে। মোর্চা নেতাদের বার্তা, ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’র কারণে যেমন পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে তাঁরা সরতে পারবেন না, তেমনই তরাই-ডুয়ার্সের ৩৯৬টি মৌজার দাবিও বর্জন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শ্যামল সেনের রিপোর্ট যাচাই করতে সচিব পর্যায়ের কমিটি গড়া নিয়ে সরকারি তরফেই আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু আলোচনায় ঠিক হয়, রিপোর্ট নয়, যে সব তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ওই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, শুধু তা-ই খতিয়ে দেখা হবে। তবে নতুন কমিটি নিজে থেকে কোনও তথ্য যাচাই করতে যাবে না। কেউ কোনও তথ্য সম্পর্কে আপত্তি তুললে তবেই তা খতিয়ে দেখা হবে। সে ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে অসম্মান করার অভিযোগ উঠলেও, সরকার তা অগ্রাহ্য করতে পারবে।
মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, নতুন কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। ফলে কেবল ‘সময় নিতেই’ ওই কমিটি গড়া হল কি না, উঠেছে সে প্রশ্নও। মুখ্যসচিব বলেন, “মোর্চা নেতারা শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্টে তথ্যগত ভুল রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। তাঁদের বলা হয়েছে, আগের রিপোর্টে কোথায় তথ্যের ভুল রয়েছে, তা তাঁরা তথ্য যাচাই কমিটিকে জানাবেন।”
দ্বিতীয় কমিটি গঠনের কথা শুনেছেন শ্যামল সেনও। তাঁর বক্তব্য, “সরকার যা ভাল বুঝেছে, করেছে। তারা আমার রিপোর্ট গ্রহণ করতে পারে, বাতিলও করতে পারে। এতে আমার কী বলার থাকতে পারে? কয়েকটি মাপকাঠি ঠিক করে দিয়ে আমাকে রিপোর্ট দিতে বলেছিল সরকার। আমি তা মেনেছি।” রিপোর্ট তৈরির আগে কি কমিটি এলাকায় গিয়ে তথ্য যাচাই করেছিল? শ্যামলবাবুর জবাব, “ঠিক হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট দুই জেলার জেলাশাসকদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির জেলাশাসকেরা এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আমার কাছে রিপোর্ট দিয়েছেন।”
এ দিনের বৈঠকে রাজ্যের তরফে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং উন্নয়ন ও পরিকল্পনামন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, জিটিএ-র জন্য নতুন করে ৪৫টি আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই আসন নির্দিষ্ট করে ভোট প্রক্রিয়া শুরুর বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। রোশন গিরি বলেন, “ভোট নিয়ে কথা বলতে আসিনি। ভোট নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।” দলীয় সূত্রের খবর, আজ, রবিবার মোর্চা নেতারা দার্জিলিঙে পৌঁছলে অন্যান্য সব আন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘটনাপ্রবাহকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে মোর্চা-বিরোধী শিবির। জিএনএলএফের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার মন্তব্য, “নতুন ৩৯৬টি মৌজার তথ্য খতিয়ে দেখতে চাইলে ক’বছর লাগতে পারে? আসলে এ সবই মুখরক্ষার কৌশল ছাড়া
কিছু নয়।” আদিবাসী বিকাশ পরিষদের তরফে জানানো হয়েছে, রাজ্য সরকার মোর্চার দাবি মেনে সরাসরি শ্যামল সেন কমিটির সুপারিশ খারিজ না করায় তারা খুশি। |