বয়স মোটে দুই। কিন্তু দিনে অন্তত সাড়ে ছ’কেজি দুধ লাগে।
বাবা-মা অস্থির। যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে এই খোরাক জোগানো কঠিন। অথচ মেয়ের ওই অতটা দুধই চাই! অন্য কিছুই সে মুখে তোলে না।
বর্ধমানের মন্তেশ্বর এলাকার আজহারনগর গ্রাম। সেখানেই স্ত্রী ফারসিনা আর চার মেয়ে-এক ছেলে নিয়ে টানাটানির সংসার আবদুল খালেদ মণ্ডলের। বাড়ি-বাড়ি মাংস ফেরি করে দিনে শ’খানেক টাকা আয় হয় তাঁর। তাতেই কোনও রকমে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু ছোট মেয়ে দুলালির দুধের খিদে তাঁদের সব হিসেব গড়বড় করে দিয়েছে।
বছর সাতেক আগে, ২০০৫-এর মে মাসে এমনই একটি শিশুকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের ১১ মাসের সেই শিশুর নাম ছিল লোকমান। কলকাতায় এনেও তাকে বাঁচানো যায়নি। পরে ওই জেলারই অরঙ্গাবাদের আর এক শিশু খুশবুর ‘অতিক্ষুধা’ও চর্চার বিষয় হয়েছিল। সে আপাতত সুস্থই আছে। এ বার দুলালির জন্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন তার বাবা-মা।
কালনা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে আজহারনগর। সরু রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলে ডান দিকে বাঁশতলা, তার পাশে অ্যাসবেসটসের চাল দেওয়া এক কামরার বাড়ি। সামনে খুঁটোয় বাঁধা দু’তিনটি ছাগল, চরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি হাঁস। ওই একখানি ধরেই সাতটি প্রাণীর বাস। চারদিকে অভাবের চিহ্ন প্রকট। কয়লা জোটে না, মাটির উনুনে কুড়নো পাতা-কুটো জ্বালিয়ে হাঁড়ি চড়ে। |
ঘরের দাওয়ায় মেয়ে কোলে করে বসে থাকেন ফারসিনা। মেয়ে যতক্ষণ ঘুমোয়, ততক্ষণই শান্তি। ঘুম ভাঙলেই মুখে ধরতে হবে দুধের বোতল। ফারসিনা জানান, জন্মের পরে ক’দিন ব্যাপারটা ঠাহর হয়নি। মাস চারেক হতে না হতে শুধু মায়ের দুধে আর চলছিল না। বাধ্য হয়ে গরুর দুধ দিতে হয়েছিল। এর পর থেকে আর কিছু খায় না সে। মায়ের দুধ তো নয়ই, ভাত-মুড়িও না। মুখে দিলে উগরে দেয়। দুলালির বড়দিদি, পুড়শুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রূপালির কথায়, “দুধে সামান্য জল থাকলেও বোন খেতে চায় না। এখন বাবার রোজগারের বেশির ভাগটা ওর দুধ কিনতেই চলে যায়।”
আপাতত গোয়ালার কাছে ৪০০ কেজি দুধের দাম বাকি। রোজ তাগাদা দিচ্ছে। দুলালির বাবা আবদুল বলেন, “গোয়ালাকে বলেছি, দুধ দেওয়া বন্ধ কোরো না। যে ভাবে পারি, সব দাম মিটিয়ে দেব।” কিন্তু মেয়ের চাহিদা দিন-কে-দিন বেড়েই চলেছে। চোখ খুলে দুধ না পেলে চিৎকার। দেরি হয়ে গেলে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে নিজের হাতের চামড়া। বেশি সমস্যা হয় রাতে দুধ ফুরিয়ে গেলে। বেশ কয়েক বার এমনও হয়েছে যে মাঝরাতে দুধ খুঁজতে বেরোতে হয়েছে আবদুলকে। বাধ্য হয়ে এখন বাড়িতে ৫০০ গ্রাম কৌটোর দুধ রাখেন। তবে তাতেও গোটা সপ্তাহ চলে না।
এত খেয়েও কিন্তু হাঁটতে পারে না দুলালি। দাঁড়াতে পারে না, বসতেও পারে না। পা দু’টো সরু-সরু। কোনও রোগ থাকতে পারে ভেবে জন্ম থেকে তাকে পোলিও টিকা খাওয়ানো হয়নি। ফারসিনা বলেন, “অত দুধ খেয়েও ও কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। দু’সপ্তাহ বাদে হয়তো এক বার হল।” কিন্তু কী তার অসুবিধা, তা জানতে কোনও পরীক্ষা হয়নি।
হরমোন বিশেষজ্ঞ তীর্থঙ্কর চৌধুরীর মতে, নানা কারণে এ রকম পরিস্থিতি হতে পারে। প্রথম থেকেই যদি অভিভাবকেরা শিশুকে জোর করে বেশি খাওয়ান, তার খিদে বেড়ে যেতে পারে। অনেকের আবার ‘হাইপোথ্যালামিক ডিসর্ডার’ থাকে। দেহে হরমোনের তারতম্য বা নিউরোলজিক্যাল ডিসর্ডারের কারণে খিদে বেশি পায়। অনেকের অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন সৃষ্টিকারী টিউমার জন্মায়। ইনসুলিন বেশি ক্ষরণ হলে শরীরে শর্করা কমে যায়। ফলে খিদে আপনা থেকেই বেড়ে যায়। এই শিশুটিকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এর মধ্যে কোনওটি তার আছে কি না।
পরীক্ষা করবে কে?
গ্রামের হাফিজুল শেখ, রিজাবুল শেখরা বলেন, “এমনিতেই বছরভর কষ্টে ওদের সংসার চলে। তার মধ্যে দুধের জোগাড় করতে গিয়ে এখন তো প্রায় নিঃস্ব অবস্থা!” সাহায্য চেয়ে মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চাঁদু দাস এবং জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ অশেষ কোনারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন আবদুল। দু’জনের কেউই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’কে জানাবেন বলা ছাড়া কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি।
কাটোয়ার মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি বলেন, “বিডিও-র কাছে আবেদন জানিয়ে ওঁরা সরকারি ত্রাণ পেতে পারেন। তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, মেয়েটি অসুস্থ। তার চিকিৎসার ব্যাপারে আবেদন জানানো হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |