নগরাঞ্চলে দিনপ্রতি বত্রিশ টাকা। গ্রাম হইলে ঈষৎ কমিয়া ছাব্বিশ। অথবা, মাসে নব্বই হাজার, অর্থাৎ গড় হিসাবে প্রত্যহ তিন সহস্র। এই দুইটি অঙ্কের ভিতর ঘুরপাক খাইতেছে একটি গভীর প্রশ্ন। কে ধনী, এবং কে-ই বা দরিদ্র? যোজনা কমিশন জানাইয়াছে, দিনপ্রতি বত্রিশ টাকা আয় হইলেই তিনি আর ‘দরিদ্র’ নহেন। অন্য দিকে, মুম্বইতে অতি সম্প্রতি পার্সি জনগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিগণ তাহাদের নিজস্ব হিসাব কষিয়া স্থির করিয়াছেন, এই নগরে কোনও পার্সি মাসে নব্বই হাজার টাকা আয় করিয়া থাকিলে তাঁহাকে আর ‘দরিদ্র’ বলা চলিবে না। অর্থাৎ, ধনী এবং দরিদ্রের সংজ্ঞাটি নিতান্তই আপেক্ষিক। বক-রূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, কী ত্যাগ করিলে মানুষ ধনী হইয়া উঠে? যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়াছিলেন, বাসনা। বাসনার বশে মন অবিরত, ধায় দশ দিশে পাগলের মতো, ইহা নিছকই কবি-কথা নহে। কিন্তু, বাসনা ত্যাগ করিলেই কি সমৃদ্ধি আসিবে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলিবার নহে। ‘যে ধনী হইয়া ধনী, মণিরে না মানো মণি, তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে’ বলিয়া একদা এক নৃপতি একটি বহুমূল্য মণি নদীতে ছুড়িয়া ফেলিয়াছিলেন। কী সেই ধন যাহা মণিরত্নের চাহিদাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করিতে শিখায়? আবার, কী সেই বাসনা যাহা ছিন্নকন্থা ব্যক্তিকেও তাড়িত করিয়া ফিরে, এক সময় তাহাকেই ধনাঢ্যে পরিণত করে? সেই বাসনা কি অসঙ্গত? একটি গ্যারাজ-ঘর হইতে একটি উদ্যোগ-সাম্রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছিবার যে তীব্র ইচ্ছাশক্তি এবং প্রবল উদ্যম, তাহা কি নিছকই মূল্যহীন? |
প্রকৃত প্রস্তাবে, বাসনা-ত্যাগ এবং বাসনার পশ্চাদ্ধাবন, উভয়েরই অন্তরালে আছে এক ধরনের আত্ম-সন্ধান। আছে আত্ম-প্রকাশের ইচ্ছা। শুধু, ব্যক্তি হইতে ব্যক্তিতে ভঙ্গি এবং দৃষ্টিভঙ্গিটি পৃথক হইয়া যায়। সেই বিভিন্নতা মানুষের প্রকৃতিতে নিহিত বৈচিত্রের স্মারকও বটে। কেহ ত্যাগের ভিতর সার্থকতা খুঁজিয়া পান। কেহ আবার নব নব সম্পদশালী হইবার আকাঙ্ক্ষায় অস্থির। এই রূপে, দুই হাতেই বাজিয়া উঠে কালের মন্দিরা। ডাহিনে ও বামে। কে ধনী এবং কে-ই বা দরিদ্র, এই বিতর্কের সূত্রে একটি কাহিনি উল্লেখ্য। কথিত আছে, এক অতীব বিত্তবান পিতা তাঁহার পুত্রকে গ্রামে লইয়া গিয়াছিলেন, দরিদ্রজন কী রূপে বাঁচেন, তাহা সেই বালকটিকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখাইবার বাসনায়। গ্রামে গিয়া এক হতদরিদ্রের কুটিরে তাঁহারা রাত্রিবাস করিলেন। ফিরিবার কালে পুত্রকে পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন দেখিলে? পুত্র সবিস্ময়ে কহিল, আশ্চর্য! পিতা বলিলেন, আশ্চর্য কী? পুত্র বলিল, এই ইঁহাদের জীবনযাপন! আমাদের বিরাট বাগান আছে, ইঁহাদের দিগন্ত পর্যন্ত মাঠ। আমাদের সাঁতারের পুষ্করিণীটি বড়, ইঁহাদের বাড়ির পাশে একটি সম্পূর্ণ নদী। আমাদের ধনসম্পত্তি প্রাচীর দিয়া সুরক্ষিত। ইঁহাদের রক্ষা করিবার জন্য গ্রাম জুড়িয়া অজস্র বন্ধুজন। আমাদের গৃহে সুসজ্জিত বিদেশি লণ্ঠন ঝুলিয়া থাকে। ইঁহারা চক্ষু মেলিলে তারাভরা আকাশ। আশ্চর্য! ধন্যবাদ পিতা, এই গ্রামে আমাকে লইয়া আসিবার জন্য। এত দিনে আমি বুঝিয়াছি, সত্যই আমরা কত দরিদ্র! পুত্রের কথায় পিতা বাক্যহারা। বসিয়া থাকিলেন, স্তব্ধ। |