ভোটের অঙ্কে এখনও পর্যন্ত প্রণব মুখোপাধ্যায় খানিকটা এগিয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্ভবত হচ্ছে না রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
গত কাল দলের প্রার্থী হিসেবে প্রণবের নাম ঘোষণার পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ নিজেই প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র সামনের সারির নেতাদের ফোন করেন। আজ প্রণববাবু ফোন করলেন এনডিএ শরিক নীতীশ কুমারকে। কিন্তু এ দিন সন্ধ্যায় নিতিন গডকড়ীর বাড়িতে বিজেপির কোর কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে হেতু প্রণব মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসের প্রার্থী, তাই তারা তাঁর বিরোধিতা করবে।
রাষ্ট্রপতি ভোটে জয়টাই বিজেপির মূল লক্ষ্য নয়। যখন মূল্যবৃদ্ধি-দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস নাজেহাল, তখন বিজেপির নজর ২০১৪ সালের ভোটের দিকে। তাই তারা চাইছে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব তৈরি হোক। আর সেই কাজে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে হাতিয়ার করতে চাইছে তারা তাই আজ বিজেপি কোর কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছে, তারা প্রার্থী দেবে না। কারণ, সেই প্রার্থীকে সমর্থন জানাতে অসুবিধায় পড়বেন মমতা। বরং মমতা বা জয়ললিতার মতো যাঁরা এনডিএ-র বাইরে রয়েছেন, তাঁরা কাউকে প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরলে বিজেপি সমর্থন জানাবে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা জানালেন, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ের থেকেও আমাদের বড় লক্ষ্য লোকসভা নির্বাচন। আমরা চেষ্টা করব এক জন নির্দল প্রার্থীকে জেতাতে। তা যদি না-ও পারি, তবু মমতাকে দিয়ে প্রণববাবুর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াতে পারলে সেটা কংগ্রেসের কাছে বড় বিড়ম্বনার কারণ হবে।” রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর মমতা ইউপিএ-তে থাকবেন কি থাকবেন না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওই নেতা বললেন, “কংগ্রেসকে দুর্বল করাটাই তো বিজেপির লক্ষ্য।” এ কারণেই জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার যতই প্রণববাবুকে সমর্থনের কথা বলুন, তা শুনতে নারাজ বিজেপি নেতৃত্ব।
এ দিন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দেখা করেন এ পি জে আব্দুল কালামের সঙ্গে। তাঁর সূত্রেই জানা যাচ্ছে, কালাম ভোটে প্রার্থী হতে আর রাজি নন। তিনি বুঝতে পারছেন, প্রার্থী হলেও তাঁর পক্ষে জেতা মুশকিল। ভৈরোঁ সিংহ শেখাওয়াত যে ভাবে প্রতীকী লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সে ভাবে প্রাণপাত করতে নারাজ এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। অবশ্য মমতা এখনও কালামকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আজ ফেসবুকে কালামের হয়ে প্রচার শুরু করেছেন তিনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সমর্থনে মিছিলও বেরিয়েছে কলকাতায়। তবে এর পাশাপাশি মমতার বিকল্প পরিকল্পনাও রয়েছে। তা হল, কালাম রাজি না হলে অন্য কোনও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রার্থী করে তাঁর জন্য সব দলের কাছে সমর্থন চাওয়া।
এনসিপি নেতা পূর্ণ সাংমা এখনও দৌড়ে রয়েছেন। তাঁকে প্রার্থী করতে অবশ্য মমতা প্রাথমিক ভাবে উৎসাহী ছিলেন না। কারণ, সাংমা তৃণমূলের জন্মলগ্নে যোগ দিলেও পরে এনসিপিতে ফিরে যান। মেয়েকে ইউপিএ মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও করেন তিনি। তাই সাংমাকে প্রার্থী করতে সে ভাবে আগ্রহী ছিলেন না মমতা। তবে নবীন পট্টনায়ক ও জয়ললিতা সমর্থন করছেন সাংমাকে। তাঁদের একটি ভোটব্যাঙ্কও রয়েছে। এ হেন পরিস্থিতিতে গডকড়ীদের রণকৌশল হল, কালাম যদি না দাঁড়ান এবং জয়ললিতা যদি সাংমার নাম ঘোষণা করে দেন, তা হলে তাঁকে তাঁরা সমর্থন জানাবেন। তখন মমতাকেও নবীন-জয়া অনুরোধ করবেন, তিনিও যেন সাংমাকে সমর্থন করেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, কালাম যদি না দাঁড়ান (যে সম্ভাবনা এখন প্রবল), তা হলে সাংমাকে সমর্থনের সম্ভাবনাও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে অন্ধ্রের উপনির্বাচনে জগন্মোহন রেড্ডির হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে কংগ্রেস। জগনের মাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতা। অর্থাৎ, ছোটখাটো কাউকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক সূত্র বলছে, সাংমা প্রার্থী হলে একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে উত্তর-পূর্বের ভোটব্যাঙ্কও, তা সে সংখ্যায় যতই কম হোক। পাশাপাশি মুলায়ম সিংহকেও বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, কংগ্রেস-বিরোধী মঞ্চে তাঁকে খুবই প্রয়োজন। মমতাও কার্যত এই মঞ্চে ঢুকে পড়েছেন। কংগ্রেস এখন মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির অভিযোগে নাজেহাল। এই অবস্থায় তাদের সমর্থনের চেয়ে মুলায়ম যদি বিরোধী মঞ্চে থাকেন, তা হলে ২০১৪-এর ভোটের পরে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
কংগ্রেস সূত্র মেনে নিচ্ছে, সাংমা একা বিরোধী প্রার্থী হলে জোর লড়াই হওয়ারই সম্ভাবনা। বিরোধীদেরও দাবি, সে ক্ষেত্রে অঙ্কের দিক থেকে তাঁদের প্রার্থীর জয় একেবারে অসম্ভব নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা যদি প্রণববাবুর বিরুদ্ধে ভোট দেন, তা হলে সনিয়া গাঁধী কি তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন?
কংগ্রেস সূত্র বলছে, সনিয়া কিন্তু এত কিছুর পরেও চান না, মমতা ইউপিএ ছেড়ে চলে যান। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছেন, মমতা এবং মুলায়ম দু’জনেই ইউপিএ-র মধ্যে থাকুন। কারণ, রাষ্ট্রপতি ভোটপর্বে মমতার সঙ্গে যে ভাবে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন মুলায়ম, ভবিষ্যতে যে সনিয়ার সঙ্গেও তেমন করবেন না, তা-ই বা কে বলতে পারে? নারায়ণন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মুলায়মের জন্যই সনিয়া সরকার গঠন করতে পারেননি। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার দাবি তুলে তিনি গোটা পরিস্থিতি গুলিয়ে দিয়েছিলেন। পরমাণু চুক্তি নিয়েও শেষ মুহূর্তে বামেদের সঙ্গেও বিশ্বাসভঙ্গ করেছিলেন। তাই মমতা ও মুলায়ম দু’জনেই ইউপিএ-র সঙ্গে থাকলে কংগ্রেসের চাপ কম থাকবে। এক জনের কথা তুলে অন্য জনকে বোঝানো সম্ভব হবে, সরকার কারও একার উপর নির্ভরশীল নয়। তাই আহমেদ পটেল আরও এক বার চেষ্টা করবেন মমতাকে বুঝিয়েসুজিয়ে সংঘাত মেটানোর। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার আগে এমন কথাও প্রণববাবুকে বলেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি যেন অবজ্ঞা করা না হয়। প্রণববাবু শীঘ্রই বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তিনিও এই বার্তা দিতে চান না যে, অর্থমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের জন্য তিনি কিছু করেননি।
তবে মমতার দিক থেকে এখনও ইতিবাচক সাড়া নেই। উল্টে জয়-পরাজয়ের পরোয়া না করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথে যাচ্ছেন তিনি। অবশ্য ইউপিএ ছাড়া বা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার মতো সিদ্ধান্ত তিনি চটজলদি নিতে চাইছেন না। বিজেপির থেকে শত সহস্র যোজন দূরেও থাকতে চাইছেন। কারণ, মমতা জানেন, তিনি মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে উঠেছেন। এই অবস্থায় বিজেপির দিকে ঝুঁকে সংখ্যালঘু ভাবাবেগে আঘাত করাটা তাঁর লক্ষ্য নয়। কিন্তু কেউ যদি মমতার সমর্থন নিয়ে প্রণববাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়ান আর তাঁকে যদি এনডিএ সমর্থন করে, তবে সেটা মমতার বিচার্য বিষয় নয়। জয়ার প্রার্থীকেও মমতা এবং বিজেপি উভয়েই সমর্থন জানাতে পারেন। বিজেপিও সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে প্রার্থী দেবে না বলে ঠিক করেছে। আর তাতেই জমে উঠেছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
|