|
|
|
|
|
|
|
ছবির বীজতলা |
আচার্য নন্দলাল বসুর হাতে 'কার্ড' হয়ে উঠেছিল এক আশ্চর্য সৃষ্টির মাধ্যম।
নিজস্ব সুরে আর লয়ে পূর্ণ।
কখনওবা রঙে রসে ভরা এক বৃহত্তরের সূচনা। লিখছেন অমৃতলাল বেগড়
|
এক দিন সন্ধেবেলা আমি বেড়িয়ে ফিরছিলাম। আঁধার ঘনিয়ে আসছিল। রাস্তায় তিনটি বাচ্চা মেয়ে আমায় ঘিরে ধরে বলল— ‘আমাদের কার্ড দিন।’ ভাবলাম, এরা বোধ হয় আশ্রমের কেউ নয়। জানতে চাই, ‘তোমরা কে?’ ‘যেই হই না কেন, আমরা কার্ড চাই।’ তাদের স্বরে ছিল আদেশ, তাই পালন করতেই হয়। খানিক এগিয়ে বিজলি বাতির নীচে দাঁড়িয়ে কার্ড বানিয়ে তাদের দিলাম। তার পর জিজ্ঞেস করি— ‘এ বার তো আমি যেতে পারি?’ তারা বলল, ‘আরও একটা কার্ড চাই, আমরা তো চার জন।’
ঘটনাটি আমি স্বয়ং আচার্য নন্দলাল বসুর মুখ থেকে শুনেছিলাম। এমনটি প্রায় তিরিশ বছর ধরে চলতে থাকে। তাই ভারতের প্রতিটি প্রান্তে এমন অনেক লোক পাবেন যাঁদের কাছে নন্দবাবুর কার্ড আছে। কখনও কখনও নন্দবাবু বড় আত্মসন্তুষ্টির সঙ্গে বলতেন ‘আমার নিজের কাছে যত কার্ড আছে, তার দশগুণ কার্ড আমি অন্যদের দিয়েছি।’ আর সে সময় তাঁর কাছে যত কার্ড ছিল, তার সংখ্যা অন্তত দেড় হাজার হবে।
নন্দবাবুর পকেটে সব সময় তাঁর মেয়ে গৌরীদির হাতে বানানো চামড়ার বটুয়া থাকত, যাতে অনেক আনকোরা কার্ড, কিছু আঁকা কার্ড আর এক টুকরো পেন্সিল থাকত। পথে যেতে যেতে সুন্দর কোনও দৃশ্য নন্দবাবু নোট করছেন এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া শান্তিনিকেতনে সাধারণ ব্যাপার ছিল।
কার্ডে ছবি আঁকার প্রচলন করেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছাত্রদের পোস্ট কার্ড লেখার সময় তাতে কিছু একটা এঁকে দিতেন। তাই কার্ডের প্রচলন পত্রসাহিত্য রূপেই প্রথম দেখা দেয়। কাউকে চিঠি লিখতে হবে অথবা লেখার মতো কিছু না থাকলেও কার্ডে ছবি আঁকার প্রচলন চলতে থাকে। নন্দবাবু লক্ষ করেছিলেন, কার্ডের ব্যবহার খুব সুবিধেজনক। আকারে ছোট বলে সব সময় কাছে রাখা যায় এবং ছবি আঁকার উপযুক্ত একটা কাগজ কাছে থাকে। পত্রোত্তরে ব্যবহারে তো বটেই, তা ছাড়া বছরের প্রথম পিকনিকে প্রতিটি নতুন ছাত্রকে এবং ডিসেম্বরের এক্সকারশনের পর প্রত্যেক ছাত্রকে কার্ড দেওয়া তাঁর নিয়ম ছিল।
এই কার্ড আসলে কী?
প্রকৃতির বৈচিত্রভরা বিশালত্ব থেকে অঞ্জলি ভরে যে সৌন্দর্য নন্দবাবু আকণ্ঠ পান করতেন তাকেই মূর্তরূপ দেওয়ার স্থান এই কার্ড। নন্দলাল প্রকৃতিকে মানুষের চেয়ে কম গুরুত্ব দেননি। এরই মধ্যে প্রকৃতির সহজ ছন্দ ফুটে উঠত। প্রকৃতিলীলা এবং জনজীবনকে মুখরিত করতে এই কার্ডে স্থাবর-জঙ্গম, বন-পর্বত, নদী-সমুদ্র, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ সব কিছুর সমাবেশ ঘটেছে। এই সব কার্ড ধরার সৌন্দর্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাঁর নিজস্ব শৈলী। উনি ধরিত্রীর শিল্পী ছিলেন, শব্দ-স্পর্শ, রূপ-রস, গন্ধময়ী ধরার শিল্পী।
নন্দবাবুর কার্ড তাঁর আরম্ভিক ছবিগুলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর আরম্ভিক ছবিগুলির বিষয় প্রায়শ ধার্মিক অথবা পৌরাণিক হত। কলকাতায় ছবি আঁকার জন্যে অন্য কোনও বিষয়ই পাচ্ছিলেন না, কিন্তু শান্তিনিকেতনে এসেই যেন তিনি দেবপ্রয়াগ থেকে গ্রামপ্রয়াগে এসে পড়লেন। ফসলে ভরা সবুজ খেত, উদার মাঠ, খোয়াই, সাঁওতাল আদিবাসী, নৃত্যনাটিকা, অনন্ত আকাশ... ছবি আঁকার কত শত বিষয়। শান্তিনিকেতন তাঁর সর্বত্র পল্লবিত হওয়ার নিমিত্ত হয়ে দেখা দিল। প্রকৃতির ছোট ছোট বস্তুও তাঁর সংবেদনশীল মনকে চমৎকৃত ও বিস্মিত করত। তিনি প্রকৃতি থেকে প্রেরণা নিতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর চেষ্টা থাকত তাঁর অঙ্কন শুধুমাত্র প্রকৃতি না হয়ে যেন যথার্থ শিল্প হয়ে ওঠে। এ সবই সম্ভব হত তাঁর কল্পনাপ্রবণতার জন্যে। চোখ বস্তুর বাহ্য আকার দেখে, মন তার মধ্যে নিহিত ছন্দ বা লয়কে ধরে। যখন এই দুইয়ের মিলন ঘটে তখনই পরিপূর্ণতার ভাব আসে। এই সব কার্ডে যতটা বাহ্য প্রকৃতি থাকে ততটাই থাকে শিল্পীর অন্তরের দুনিয়া। প্রকৃতির সঙ্গে তন্ময় হতেন বলেই নন্দলালের মনে এত নব নব ভাবের আবির্ভাব হত। তা থেকে প্রতিটি ভাবকে যদি বড় আকারের ছবিতে ব্যক্ত করতে চাইতেন তা হলে হাজার হাজার ছবি জন্মাতই না।
যদিও তাঁর অনেক কার্ডেই ছবির আনন্দ অনুভব করা যায়, কিন্তু কার্ড তো কার্ডই আর ছবি ছবিই। কার্ড যেন চার পঙ্ক্তির ছোট্ট একটি কবিতা এবং ছবি যেন প্রবন্ধকাব্য। একটি ঝরনা তো অপরটি সরোবর। কার্ড বানানোর সময় নন্দলাল ভাবতেন কম কিন্তু মনের অনুভূতির প্রকাশ থাকত অনেক বেশি। সেখানে ব্যাকরণের বাঁধন কিছুটা ঢিলে হত। কখনও তুলির তড়িৎ আঘাতে বাহিরকে দেখানই প্রধান উদ্দেশ্য হত, বিষয় হত গৌণ। ছবির মধ্যে কিছু লিখে দেওয়ার রীতিও ছিল।
কার্ড তৈরির কৌশল ছিল তাঁর নিজস্ব। তাঁর যা কিছু ভাল লাগত একটি কার্ডে তা নোট করে নিতেন। মুখ্য ক্রিয়াকে অল্প কয়েকটি রেখার সাহায্যে নোট করতেন। একই কার্ডে ৮-১০টি নোটস থাকত। ব্যস, এই সব ইঙ্গিত থেকেই বাড়ি ফিরে অনেক কার্ড বানিয়ে ফেলতেন। তাঁর এমনই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে অনেক সময় এই সব ইঙ্গিতেরও প্রয়োজন হত না। উনি বলতেন, ‘শিল্পী যা কিছু সুন্দর দেখে, নিজেই তার মধ্যে প্রবেশ করে যায়।’
কিছু কিছু কার্ডের ভিতর বড় ছবির বীজ লুকিয়ে থাকে। বাসা ছাড়া পাখির মতো তিনি উড়ে যেতেন আর বড় একটি ছবির জন্ম হত। নন্দলালের শ্রেষ্ঠ চিত্রগুলির মধ্যে একটি ‘কৃষ্ণকলি’। ওড়িশার এক শীর্ণ, ছিপছিপে নারী যার প্রতিটি অঙ্গ থেকে কোমলতা ঝরে পড়ছে, একটি স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে চিন্তিত মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে। কেবল চাইনিজ ইঙ্ক (কালো কালি) দিয়ে নেপালি কাগজে (হাতে তৈরি কাগজ) তৈরি এই ছবি ‘টাচ ওয়ার্কের’ শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। মূলে কিন্তু এটি একটি কার্ডই ছিল।
গোপালপুর ওড়িশার সমুদ্রতটে সুন্দর একটি গ্রাম। গ্রীষ্মের ছুটিতে নন্দলাল প্রায়ই সেখানে যেতেন। ভোরবেলা সমুদ্রতটে হাঁটতে বেরিয়ে পড়তেন এবং চার পাশের সব কিছু প্রাণ ভরে দেখতেন। ঘরে ফিরে এসে আত্মসাৎ করা সৌন্দর্যকে কার্ডে মূতর্ রূপ দিতেন। এক বার আঁকতে বসেই অনেক কার্ডের জন্ম হত কোনওটা তুলি দিয়ে, কোনওটা নিব দিয়ে, কোনওটা খাগের কলম দিয়ে, কোনওটা কালো কালি দিয়ে, কোনওটা আবার রং দিয়ে। উৎকর্ষে একটি যেন অপরটিকে ছাপিয়ে যায়। কখনও কখনও তিন-চারটে কার্ড একটার পর একটা জুড়ে তৈরি হয়ে যেত লম্বা একটা প্যানেল। এমনই শয়ে শয়ে কার্ড আছে পুরী, রাজগীর, খড়্গপুর, হাজারিবাগ, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, হরিপুরা আরও না জানি কত জায়গার।
তাঁর কার্ডগুলি হত হৃদয় থেকে উৎসারিত, যথার্থ অঙ্কন নয়। উনি বাস্তব আকারকে বিশেষ অদলবদল করতেন না। তাও সেগুলিকে নয়নাভিরাম রূপে বদলে দিতেন। এটা সম্ভব হত তাঁর কল্পনাপ্রবণ মন ছিল বলে। তাঁর কল্পনাশীলতা ও লয়াত্মকতা প্রত্যেক বস্তুকে কলাকৃতির রূপ দিত। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে কল্পনাশক্তির উপর তাঁর আশ্চর্যজনক প্রভুত্বের ছটা দেখা যেত সেই কল্পনা যা বাস্তবের পরে ভিত্তি করেই সৃষ্ট। এই সব কার্ড এ কথাই প্রমাণ করে যে সাচ্চা কলাকারের কাছে প্রত্যেক সাধারণ বস্তু অসাধারণ রূপে প্রতিভাত হয়। তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ এই সব কার্ডগুলিতে সুরক্ষিত আছে। উনি খুব কার্ড বানাতেন আর মুক্ত হস্তে বিতরণও করতেন। তাঁর হাজার হাজার কার্ডের মধ্যে আমি কেবল সাতটি কার্ড নিয়ে আলোচনা করব।
|
১ |
|
এক বার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি অনেকগুলি বাঁদরের স্কেচ করেছি। মাস্টারমশাইয়ের (নন্দবাবু) কাছে গিয়ে দেখালাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে বাঁদরের শরীরের গঠন, বাঁদর ও মানুষের মাথার প্রভেদ, বাঁদরের অঙ্গ চালনার লক্ষণগুলি কার্ডে এঁকে দেখালেন। এই ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে আমার জন্মদিন। আমি প্রণাম করতে গেলাম। উনি আশীর্বাদ দিলেন এবং বসতে বললেন। কার্ড বানানো শুরু করলেন। শেষ হলে আমাকে উপহার দিলেন। দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। অশ্বত্থের ডালে দু’টি বাঁদর বসে আছে! (পাশের সাদাকালো ছবি) সজীব বাঁদর, যেন এক্ষুনি গাছ থেকে নেমে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। বাংলায় লেখা ছিল ‘অমৃতলালের জন্মদিন মাস্টারমশাইয়ের আশীর্বাদ।’ তা হলে ওঁর মনে ছিল, আমি বাঁদর নিয়ে স্টাডি করছিলাম। তাই কার্ডে বাঁদরের ছবি এঁকে দিলেন। ছোট্ট কার্ডের উপর বাঁদরের পায়ের আঙুল পর্যন্ত সূক্ষ্ম, ডিটেলের কাজ আশ্চর্যজনক। এই কার্ড দেখে প্রসিদ্ধ চিত্রকর কে কে হেব্বর বলেছিলেন ‘বাঁদরের পায়ের কেবল আঙুলগুলি দেখে যে কেউ বলে দেবে যে এটি এক মহান শিল্পীর রচনা।’ (এই কার্ড দেখে আমি একটি রঙিন কোলাজ করেছিলাম (পাশের রঙিন ছবিটি) কিন্তু কোথায় সেই অবিস্মরণীয়, অনুপম কার্ড আর কোথায় আমার দরিদ্র কোলাজ!)
|
২ |
পরের বছর আমার জন্মদিনের আগে রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাটিকা মঞ্চস্থ হয়েছিল। এর পাত্রদের বেশভূষায় আকর্ষণীয় লাগছিল ঠিকই, কিন্তু তারা নিষ্প্রাণ যন্ত্রের মতো কাজ করছিল। মনুষ্যসুলভ ভাব থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। এই কৌতুকপূর্ণ নাটিকার সন্দেশ ছিল আমরা যেন যন্ত্রমানব না হই। এই পাত্রপাত্রীর বেশভূষা এবং মঞ্চসজ্জা নন্দলাল নিজেই করেছিলেন। এই নাটিকার আমন্ত্রণ পত্র ছিল তাঁর কার্ড। এ বার উনি হিন্দিতে লিখেছিলেন, ‘অমৃতলালকা জন্মদিন। চিড়িতন, হরতন, ইস্কাবন। নন্দ ৩-১০-১৯৫০।’ এই কার্ডকে যতই এনলার্জ করা যায়, ততই সুন্দর দেখায়। |
|
|
৩ |
১৯৪৮ সাল। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। কলা ভবনের ছাত্ররা এক্সকারশনে বুদ্ধগয়ায় গিয়েছে। নন্দলালও সঙ্গে গিয়েছেন। শেষ দিনে প্রত্যেক ছাত্রকে একটি করে কার্ড দিয়েছিলেন নন্দলাল। আমি যে কার্ড পেয়েছিলাম তাতে এক উদাস দুপুরে বড় এক শকুন একটি শবকে চিরে ফেলছিল আর দুর্বল কয়েকটি শকুন তাদের পালা কখন আসবে তার অপেক্ষায় সময় গুনছিল। কবিগণ বোধ হয় একে বীভৎস রসের উদাহরণ বলবেন। |
|
৪ |
১৯৩৮ সালে কংগ্রেস অধিবেশন হয়েছিল গুজরাতের হরিপুরায়। সেখানে গাঁধীজি নিজের আবাসের কাছেই নন্দলালের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এক দিন তিন আদিবাসী নারী বাপুকে দর্শন করতে এসেছে। বাপু একটু মজা করলেন। বললেন, ‘ওই কুটিরে বাংলা থেকে বড় এক মহাত্মা এসে উঠেছেন, তাঁকেও দর্শন করে এস।’ এই ঘটনা থেকেই জিজ্ঞাসু ভিল নারী ত্রিমূর্তির অদ্ভুত কার্ডের জন্ম। |
|
|
৫ |
নিজের বিশাল ধনুকে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান মুগ্ধ সাঁওতাল কিশোরের বাঁকা শরীর সত্যিই দেখার মতো। কয়েকটি বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে তিনি এই কিশোরকে হুবহু চিত্রণই কেবল করেননি বরং তার ছন্দ ও লয়কেও ধরেছিলেন। |
|
|
৬ |
কখনও কখনও নন্দলাল একটি কার্ডকে দু’টুকরো করে তাতেও ছবি আঁকতেন। গাছের ডালে বর্ষার জলে ভিজতে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি কাককে এটি আধখানা কার্ডেই তৈরি। |
|
|
৭ |
প্রার্থনারত বাপুর এই স্কেচটি সেই সময়ে হয়েছিল, যখন বাপু শেষ বার শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। এতে বাপুর অন্তরের শান্তি বাপুর চেহারায় ফুটে উঠেছে। এই অদ্ভুত রেখাঙ্কন কার্ডেই হয়েছিল। এতে বাপুর হস্তাক্ষরও আছে। |
|
সাগরতটে বালুকাবেলায় কেউই একক ভাবে সব রকম সুন্দর ঝিনুক সংগ্রহ করতে পারে না। আমি কেবল সাতটি এনেছি। কারণ, শান্তিনিকেতনে সপ্তপর্ণ বৃক্ষকে পরম পবিত্র মনে করা হয়। গুরুদেবের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই গাছের নীচে পরম শান্তি অনুভব করেছিলেন। এতে একসঙ্গে সাতটি পাতা থাকে।
অমূর্ত শিল্পের এই যুগে মূর্ত যথার্থকে ব্যক্ত করতে নন্দলাল এই কার্ডগুলিতে এই চরাচর জগতের প্রতি তাঁর যে আন্তরিক মমত্ববোধ সে সবই ফুটিয়ে তুলেছেন। বিষয়ের বিচিত্র বৈভব আমাদের বিস্ময়াভিভূত করেছে। স্রষ্টা নন্দলাল শিল্পে দেবীকে এত বিবিধ প্রকারের ব্যঞ্জন দিয়ে অর্ঘ্য দিয়েছেন যে, তাঁকে শিল্পের অন্নকুট বলা যায়। প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি শৈলীতে সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার কার্ড।
নিজ রচনা প্রক্রিয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে নন্দলাল বলেন, ‘যখন এক্সকারশনে কোনও নতুন জায়গায় যাই, তখন শুরুর দু’এক দিন খুব কম কার্ড আঁকা হয়। ঘুরে দেখতে এবং নতুন জগতের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করতে এই সময়টুকু ব্যয় করতেই হয়। কিন্তু যতই দিন কাটতে থাকে, ততই কার্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষ দু’দিন তো হাত থামতেই চায় না। তাঁবুতে লণ্ঠন জ্বেলে কার্ড বানাবার পরিস্থিতি দেখা দেয়। তাও মন যেমন চায় সব কথা বলা হয়ে ওঠে না। আর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কার্ড তৈরি হয় ফেরার সময় ট্রেনে। তখন ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে সময়ও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। বেশি ভাবনা চিন্তার সময়ই পাওয়া যায় না। মনের ভাব সোজা কার্ডে প্রতিফলিত হয়। তাই এগুলি হয় খুব প্রাণবন্ত।
এই সব কার্ডে ঘাসের বাতি থেকে শুরু করে বরফের পাহাড় পর্যন্ত এবং সাঁওতাল বালক থেকে দুপুরের লু’তে উড়তে থাকা শুকনো পাতা পর্যন্ত এমন কিছুই নেই যা তাঁর তুলি থেকে সৃষ্টি হয়নি। সেখানে তরঙ্গায়িত সমুদ্র, পুরীর মন্দিরে ভোগ নিয়ে চলা পাণ্ডা, বাংলা, বিহারের গ্রামবাসীদের সম্পূর্ণ জীবন আছে, আর আছে পশুপাখি, গাছপালা, চাঁদনি রাত, শালবন, দখিনা হাওয়া আরও না জানি কত কী!
নন্দলালের কার্ডের এক আলাদা জগৎ আছে। ছোট্ট কার্ডেও তাঁর সর্বময়ী প্রতিভার স্ফূরণ দেখা যায়। উনি মুক্ত হস্তে নিজের তৈরি কার্ড উপহার দিতেন। আজ তাঁর কার্ডের দশ ভাগের এক ভাগও যদি পাওয়া যায়, তবে সে সংখ্যাও হবে হাজার হাজার। খুশির কথা এই যে, তাঁর অনেক কার্ড দিল্লির ‘গ্যালারি অব মডার্ন আর্টস’-এ সুরক্ষিত আছে।
রবীন্দ্রনাথের মতো নন্দলালও আশ্চর্যজনক নিরলস কর্মশীল ছিলেন। এমন কোনও শাখা বাকি ছিল না যার উপর তিনি কাজ করেননি। ভিত্তিচিত্র, ফ্রেস্কো, টেম্পোরা, ওয়াশ, পোস্টার, গ্রাফিক্স, মঞ্চসজ্জা, অভিনয়ের পাত্রপাত্রীর বেশভূষা, প্রতিটি বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ কাজ তিনি করেছেন।
নন্দলালের শিল্প সৃষ্টির এক দিকে আছে বিশাল আকারের ভিত্তিচিত্র, অন্য প্রান্তে আছে কার্ড। কার্ডের মতো নেহাতই মামুলি বস্তুর উপর কী অপরূপ সৌন্দর্যের সৃজন হতে পারে, আপনি যদি তা দেখতে চান তা হলে আপনাকে নন্দলালের কার্ড দেখতে হবে।
উনি যদি আর কিছুই না করতেন, কেবল কার্ডই করতেন তা হলেও তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধার পূর্ণ অধিকারী হতেন। সারাটা জীবন তিনি এ চেষ্টাই করে গিয়েছেন, যাতে অধিক সংখ্যায় লোক সৌন্দর্যের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। |
অনুবাদ: তপেন ভট্টাচার্য |
|
|
|
|
|