|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
মণিজিঞ্জির |
বাণীব্রত চক্রবর্তী |
বাথরুমে ঘষা কাচের জানলা। আকাশ দেখা যায় না। স্কাই লাইট অনেক উঁচুতে। মণিজিঞ্জির শাওয়ারের উদ্ভ্রান্ত জলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবসিত বিকেলে তার সর্বাঙ্গে জলধারা। চোখ খুললে সব ঝাপসা। জলে-জলে আঁখি আপ্লুত।
পনেরো-কুড়ি মিনিট স্নান করার পর চোখ খুলে দেখল ঘষা কাচের ওপারে একটা প্রজাপতি। ওই পতঙ্গের কী রং বুঝতে পারল না। হয়তো মথ। এখনও সন্ধে নামেনি। মথ তো নিশাচর! জানলার কাচে টোকা দিল। উড়ে গেল না। প্রজাপতির ছ'টা পা। ফিনফিনে ডানা। বেঁচে নেই নাকি! আবার টোকা দিল। উড়ে গেল। মরেনি। কুৎসিত শুঁয়োপোকা এক দিন কেমন অপরূপ প্রজাপতি হয়ে যায়। অসুন্দর থেকে সুন্দর। সুন্দরের ভেতরেও অসুন্দর লুকিয়ে থাকে। জ্ঞানাঙ্কুরের মুখটা মনে পড়ল। এমনকী অলোকরঞ্জনেরও।
ভিজে চুল ড্রায়ারে সম্পূর্ণ শুকোয়নি। মণিজিঞ্জির তার কেশবন্যাকে কী ভাবে আটকাবে! কিন্তু মনটা আজ বড় অস্থির। পণ্ডিত দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে যাবে। পণ্ডিতজি বেনারসের পাট চুকিয়ে বালিগঞ্জ প্লেসে এসে স্থিত হয়েছেন। একটা পুরনো বাড়ি কিনে একেবারে নতুন করে নিয়েছেন। বাড়িটার নাম রেখেছেন গোধূলিয়া। দশ বছর আগে সে পণ্ডিতজির কাছে নাড়া বেঁধেছিল। কত দিন তাঁর কাছে যাওয়া হয়নি। গোধূলিয়ায় সারা দিন ধ্রুপদ সঙ্গীতের তরঙ্গ বয়ে যায়।
সন্ধেবেলায় অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরল। সন্ধ্যারানি কাকা-কাকিমার কাছে অনেক দিন আছে। তাকে কাজের লোক ভাবতে ইচ্ছে করে না। বেরোবার সময় বলে গেল, 'আমার ফিরতে দেরি হলে চিন্তা কোরো না। তাড়াতাড়িও ফিরতে পারি।' মণিজিঞ্জির নিজের উদ্ভ্রান্ত মনটাকে চেনে।
এলিভেটর গ্রাউন্ড ফ্লোরে এল। হলিডে কোর্টের কমপ্লেক্সে এসে মাথা উঁচু করে আকাশের চৈতালি চাঁদটিকে দেখল। পাঁচিলের গা ঘেঁষে সারি সারি দেবদারু। বাগানের ফোয়ারায় সবুজ-বেগুনি-লালের বাহার। আর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি গেল মেন গেটের দিকে। রুপোলি রঙের চেনা গাড়িটা হলিডে কোর্টের কমপ্লেক্সের মধ্যে এক্ষুনি ঢুকবে। অটোমেটিক গেট খুলে যাচ্ছে। দারোয়ান নাথুরাম সাহেবকে সেলাম জানাচ্ছে। মণিজিঞ্জির ছুটে এসে এলিভেটরে ঢুকল। টোয়েন্টি ফাইভ নম্বর পুশ করল। এলিভেটর ছাব্বিশ তলায় উঠে যাচ্ছে।
হঠাৎ মনে পড়ল টোয়েন্টি ফিফ্থ ফ্লোরে তথাগত ঘোষের অ্যাপার্টমেন্ট। উনি লন্ডনে থাকেন। বছরে এক বার হয়তো কলকাতায় আসেন। কয়েক বছর আগে পুলিৎজার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ওঁর লেখা কোনও বই সে পড়েনি।
ছাব্বিশ তলায় তাকে কিছুক্ষণ কাটাতে হবে। ততক্ষণে তাকে না পেয়ে জ্ঞানাঙ্কুর ফিরে যাবে। এলিভেটরের ভেতরে দাঁড়িয়ে সে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করে সুইচ অফ করে দিল।
|
|
টোয়েন্টি ফিফ্থ ফ্লোরে এলিভেটর থামল। করিডরে এসে দেখল দু'পাশে সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট। কোনওটারই দরজা খোলা নেই। প্রত্যেক ফ্লোরে ষোলোটা অ্যাপার্টমেন্ট। তথাগতর কোনটা! একটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। দরজার গায়ে পেতলের ফলকে বাংলায় লেখা তথাগত ঘোষ।
ইংরেজিতে উপন্যাস লেখেন। নামের ফলক বাংলায়! কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া নয়। তবে কি উনি বন্ধ দরজার ও-পাশে আছেন? মণিজিঞ্জির ঝুম্পা লাহিড়ী-অরুন্ধতী রায় এমনকী সাবেক কালের ষষ্ঠীব্রতর বই পড়েছে। কেন তথাগতর কোনও ফিকশন এখনও পর্যন্ত পড়া হয়ে উঠল না, ভাবতে ভাবতে ডোর বেল পুশ করল। কোনও সাড়া নেই। সাড়া না পেলে শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতজির গোধূলিয়ায় চলে যাবে।
একটু পরে দরজা খুলল। নেপালি কাজের লোক। মণিজিঞ্জির বলল, 'মি. ঘোষ আছেন?' নেপালি ছেলেটি পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, 'কোথা থেকে আসছেন? আপনার নাম?' মণিজিঞ্জির বলল, 'আমি এই হলিডে কোর্টেই থাকি।' তাকে নিয়ে নেপালি ছেলেটি ড্রয়িং রুমে এল। সোফায় বসতে বলে ভেতরে গেল।
এমন সুন্দর রুচিশীল ড্রয়িং রুম সে খুব কম দেখেছে। এ পাশের ও পাশের দেওয়ালে তিনটি পেন্টিং। হুসেন, পিকাসোর পেন্টিং চিনতে পারল। অন্যটাও অচেনা নয়। কিন্তু কার আঁকা, এক্ষুনি মনে পড়ছে না।
লাল ভেলভেটের কার্টেন সরিয়ে তথাগত ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। দুধ সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। মাথায় তরঙ্গায়িত শ্বেত শুভ্র চুল। ভদ্রলোকের ছবি সে দেখেছে। ছবিতে বরাবর শার্ট-ট্রাউজারস। বয়স তো পঞ্চান্ন-ছাপান্ন। এর মধ্যে সব চুল সাদা!
উচিত ছিল উঠে দাঁড়িয়ে একটা নমস্কার করা। সেটা বাড়াবাড়ি মনে হল। অথচ উনি সেটা করে সামনের সোফায় বসলেন।
মণিজিঞ্জির বলল, 'প্রথমেই অকপটে বলি আপনার কোনও লেখা পড়িনি। এই কমপ্লেক্সে থাকি। আলাপ করতে এলাম।' উনি মৃদু হাসলেন, 'আজ এসে ভাল করেছেন। কাল এই সময় এলে আমাকে পেতেন না।' সে জিজ্ঞেস করল, 'কাল বুঝি লন্ডনে ফিরে যাচ্ছেন?' তথাগত বললেন, 'হঠাৎ লন্ডন বললেন কেন?' মণিজিঞ্জির বলল, 'শুনেছিলাম ওখানেই থাকেন।' তথাগত মাথা নাড়লেন, 'এখন ফ্রান্সে। কাল নিউ ইয়র্কে যাব।' নম্র ভাবে কথাটা বললেন। কিন্তু তার মনে হল ভদ্রলোকের কথার ভেতরে প্রচ্ছন্ন অহংকার আছে। তথাগত বললেন, 'কলকাতায় থাকতে খুব ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের সব লেখাগুলি অখণ্ড অবসর নিয়ে পড়ি।' প্রচ্ছন্ন অহংকারের ধারণাটা মণিজিঞ্জিরের মন থেকে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। এ বার সে দেওয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, 'ওই ছবিটা কার আঁকা? খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।' নেপালি ছেলেটা দু'কাপ কফি নিয়ে এল। সোনালি রঙের ট্রের ওপর আসমানি রঙের কাপ-প্লেট। সেন্টার টেবিলে কফির কাপ দু'টি রেখে চলে যাচ্ছিল। তথাগত বললেন, 'বাহাদুর। তুমি ভেতরেই থেকো। এখন দোকানে যেতে হবে না।' তার পর অতিথিকে বললেন, 'নিন। কফি খান।' উভয়ে কফিতে চুমুক দিল। তথাগত বললেন, 'ওটা গণেশ পাইনের আঁকা।' কফির কাপ থেকে মুখ তুলে মণিজিঞ্জির জিজ্ঞেস করল, 'এখন নতুন কী লিখছেন?'
তথাগত মৃদু হাসলেন, 'কয়েকটা দিনের জন্যে কলকাতায় আসা। এখানে লেখার কথা ভাবব না ঠিকই করে এসেছি। আপনি লেখেন বুঝি?' তাকে চমকে উঠতে হল। হাত-মুখ নেড়ে 'না' কথাটি সজোরেই বলল। তথাগত অবাক, 'কেন? লেখাটা বুঝি অপরাধ!' মণিজিঞ্জির বলল, 'তা তো বলিনি।' তথাগত বললেন, 'বাংলা সাহিত্য এক চিরস্থায়ী উজ্জ্বলতা নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আপনাকে দেখে কেন জানি না মনে হল আপনি লিখতে পারেন।' সে জিজ্ঞেস করল, 'বাংলা লেখা পড়েন?' উনি বললেন, 'পড়ি। কলকাতায় এলে বাংলা বই, পত্রপত্রিকা কিনে নিয়ে যাই।' মণিজিঞ্জির একটু অবাক হল, 'আপনার তো কত ব্যস্ততা। দেশ-দেশান্তরে ছোটা। তা ছাড়া নিজের লেখাও তো আছে। সময় পান?' তথাগত বললেন, 'ওরই ভেতর খানিকটা সময় বার করে নিতে হয়।' সে জিজ্ঞেস করল, 'বাংলায় লিখলেন না কেন?' উনি বললেন, 'অভ্যেস বলতে পারেন। জন্ম কলকাতায় হলেও ছেলেবেলার কিছুটা কেটেছে পূর্ববঙ্গে আর শ্রীলঙ্কায়। পড়াশোনার ওপরের দিকটা দিল্লিতে। বাকিটুকু অক্সফোর্ডে। তবে আমার লেখায় বাঙালি জীবনের কথা আছে।'
|
দুই |
মণিজিঞ্জির জ্ঞানাঙ্কুরকে এড়িয়ে চলছে। কয়েকটা দিন বাদে খানিকটা স্বস্তি এল। ব্যবসার কাজে জ্ঞানাঙ্কুর আপাতত জাপানে।
সে দিন বিকেলে এসপ্ল্যানেডের একটা ছোট্ট বুক শপ থেকে তথাগতের কয়েকটা ফিকশন কিনে নিয়ে হলিডে কোর্টে ফিরে দেখল কাকারা ইম্ফল থেকে ফিরে এসেছেন।
মণিজিঞ্জির বছরের বেশি সময় কলকাতায়। মাসখানেক থাকে বাবা-মায়ের কাছে বেনারসে। বিয়ের পরে যেতে হয়েছিল আমদাবাদে। এক নামী কাপড়ের কলে চিফ ডিজাইনার অলোকরঞ্জন। স্বামী পেন্টার। সেই সুবাদে তার পেন্টিং সম্বন্ধে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। সে দিন গণেশ পাইনের পেন্টিং চিনতে না পারার আফসোস এখনও বুকের ভেতর থেকে গেছে।
বিয়ের আট মাসের মধ্যে অলোকরঞ্জনের সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে যায়। তাকে বেনারসে ফিরে যেতে হয়। পণ্ডিতজি তখনও গোধূলিয়ায় ছিলেন। আবার ধ্রুপদী গানের ভেতর ডুবে যায়। এ দিকে কলকাতা তাকে ডাকছিল। কাকা-কাকিমা নিঃসন্তান। সে যেন তাঁদেরই মেয়ে। গানে ছেদ পড়ে। সে কলকাতায় চলে আসে। কলকাতায় কোনও একটি কলেজে চাকরি হলে ভাল হয়। তার অনার্স এবং এম এ। দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস। নেট-স্লেটের রেজাল্টও ভাল। ডক্টরেট করেনি। এই রেজাল্টেও চাকরি পাওয়া সহজ নয়। ফরাসিটা ভাল ভাবে শিখেছিল। নিউ আলিপুরে পাঁচটি মেয়েকে ফরাসি শেখায়। সপ্তাহে এক দিন। দশ হাজার টাকা মন্দ নয়।
কাকার ব্যবসা বড়। ধরনও বিচিত্র। সম্প্রতি দিল্লি-মুম্বই-গুয়াহাটি-ইম্ফলে কয়েকটা পেট্রোল পাম্প তৈরির বরাত পেয়েছেন। কাকার সূত্রেই জ্ঞানাঙ্কুরের সঙ্গে পরিচয়।
হলিডে কোর্টে সন্ধ্যারানির জিম্মায় ভাইঝিকে রেখে উদয়শংকরকে ছুটতে হচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তে। সেই সঙ্গে পত্নী করবীও। কখনও পাঁচ দিন। কখনও দশ দিন। ইম্ফলে কাটিয়ে এলেন পনেরো দিন। জ্ঞানাঙ্কুর তার সুন্দর চেহারা আর রুপোলি গাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে হলিডে কোর্টে উপস্থিত হয়। প্রথম প্রথম জ্ঞানাঙ্কুরকে তার খারাপ লাগেনি। এখন সহ্য করতে পারছে না।
আলাপের পরের দিন এলিভেটরে সকাল বেলায় তথাগতর সঙ্গে খাবার দেখা হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি।' সে নিজের নামটা বলেছিল। উনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'আপনার নামটা সুন্দর। লেখা শুরু করুন। লেখা পড়ে কেউ এই নামটা ভুলতে পারবে না।' মণিজিঞ্জির জিজ্ঞেস করেছিল, 'এখনই এয়ারপোর্টে?' সেই মৃদু হাসি, 'না, না। দুপুরে ফ্লাইট।'
তথাগতর ফিকশন তাকে টানছে। লীলা বলে একটি মেয়ের কথা আছে। 'লীলা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, জানো, মেলবোর্নে মেয়েদের টয়লেটটা ডিপারচার লাউঞ্জের অন্য দিকে। আসলে লীলার কাছে মানচিত্রের স্থানগুলি ডিপারচার লাউঞ্জের সমষ্টি। এয়ারপোর্টের ওই অংশগুলিই তার কাছে বড়।' বালিগঞ্জ, গোলপার্ক, লেক এই সব চেনা জায়গাগুলি তথাগতর কলমে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। তবে সেই সব জায়গা এখনকার নয়। পুরনো দিনের।
হঠাৎ বইটা রেখে সে দোলন কেদারায় বসে যেন তথাগতর উদ্দেশে আপন মনে বলল, আমি লিখি। কেউ জানে না। নিঃসঙ্গতা নিয়ে একটা লেখা লিখেছি। আপনাকে কেমন করে দেখাব! আপনি তো মহাদেশান্তরে চলে গিয়েছেন। কবে ফিরবেন?
চেয়ার থেকে নেমে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে লেখার প্যাড টেনে নিল। মনে মনে ভাবল তথাগতর অন্তর্দৃষ্টি আছে। বুঝেছেন সে লিখতে পারে। তার একাকিত্ব তাঁর নজর এড়িয়ে যায়নি। এই না হলে লেখক!
মোবাইল বাজছে। ফোনটা তুলে নিল। বিদেশের ফোন। তবে কি তথাগতর ফোন? তা কেমন করে হবে! উনি তো তার ফোন নম্বর জানেন না। কয়েক মুহূর্তের আলাপ। বিদেশ থেকে ফোন করতে যাবেন কেন! ভদ্রলোক এত লঘু নন। ফোন বাজছে। তা হলে হয়তো জুনের ফোন। জুন ফোনে কার্ড ভরে রিং করে। তাই এক এক সময় এক এক নম্বর। ইউনিভার্সিটির বান্ধবী। ফোন ধরতেই ঠকে গেল। জ্ঞানাঙ্কুরের গলা, 'কেমন আছেন?' সে বলল, 'ভাল।'
জ্ঞানাঙ্কুর বলল, 'আমি ভাল নেই। আপনাকে খুব মিস করছি।' মণিজিঞ্জির বলল, 'আমি একটু ব্যস্ত।' ফোনের কানেকশন কেটে দিল। মনটা তিক্ত এবং বিরক্ত। যদি এটা তথাগতর ফোন হত তা হলে কত ভাল লাগত। নিজের লেখার কথাটা বলতে পারত। জুনের ফোন হলে পুরনো দিনের কথা হত। সেই সব হারিয়ে যাওয়া দিন। কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস, ফেলিনির ফিল্ম, কিংবা ছেলেবেলায় পড়া হলদে পাখির পালকের কথা।
এখন সে কী করবে! তথাগতর বইটা পড়বে! '...লীলাদের বাড়িটা ছিল শ্রীলঙ্কায় একটা নির্জন ফাঁকা জায়গায়।' নাকি কিছু লিখবে?
আবার ফোন বাজছে। স্ক্রিনে অচেনা নম্বর। বিদেশি নয়। বেজে গেল। ধরল না। আবার বইয়ে পৃষ্ঠায় দৃষ্টিপাত করল। লীলার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে গেলে অনেক পৃষ্ঠা উল্টে যেতে হবে। তাই করল। পরে বইটা একেবারে গোড়া থেকে পড়বে।
'...তার পর ব্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলাম কেন আমার যাওয়া উচিত নয়। দূরত্ব ও বৃষ্টি এই দু'টি কারণই সব নয়। হয়তো লীলাও এই সময় বাড়িতে থাকবে না।'
বই বন্ধ করে মণিজিঞ্জির ভাবল লীলাকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। সে নিজেও যেন আস্তে আস্তে লীলা হয়ে উঠছে। আবার ফোনটা বাজল। সেই অচেনা নম্বর। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত বলে উঠল, 'আমি অলোকরঞ্জন।' অলোকরঞ্জন জানে হলিডে কোর্টে তার কাকার বাড়ি। মণিজিঞ্জির কাকার কাছেই বেশি সময় থাকে।
|
তিন |
এত দিন পর অলোকরঞ্জন! যশোমতীকে নিয়ে কলকাতায় এসেছে নাকি! তার ফোন নম্বর কোথায় পেল! তখনই মনে পড়ল এই নম্বরটা সে কোনও দিন চেঞ্জ করেনি। বলল, 'কী বলবে বলো।' অলোকরঞ্জন বলল, 'তোমার জন্যে কলকাতায় এসেছি। বাইরে এক বার দেখা করবে!' মণিজিঞ্জির জিজ্ঞেস করল, 'একা এসেছ? যশোমতী আসেনি?' অলোকরঞ্জন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তার পর বলল, 'বিয়ের কয়েক মাস পর যশোমতী মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। শপিংয়ে গিয়েছিল। আমি বাড়িতে ছিলাম।'
মণিজিঞ্জিরের বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। অলোকরঞ্জনের অসহায় মুখটা ভেসে উঠল। বিহ্বলতা দমন করে বলল, 'কী দরকার?' অলোকরঞ্জন বলল, 'ফোনে বলা যাবে না। আমার নম্বরটা সেভ করে নাও। কবে কোথায় দেখা হবে ফোন করে জানিয়ো।' অলোকরঞ্জন ফোন ছেড়ে দিল।
বই-লেখা পড়ে রইল। তার ভেতর থেকে লীলা বেরিয়ে এসে মুদ্রিত হরফের অরণ্যে মিশে গেল। তার একাকিত্ব ম্লান হয়ে গেল আর এক মানুষের অসহায়তার কাছে। বুকের ভেতরে বেদনার আট মাস যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। করুণার প্লাবন বুক থেকে উঠে এল চোখে। অশ্রু বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিল তার গাল। ইচ্ছে হল এক্ষুনি অলোকরঞ্জনকে ফোন করতে। রিসিভড কলে নম্বরটা আছে। ফোনটা তুলে নিল। আবার কী ভেবে রেখে দিল। চৈত্রের দুপুর। আজ নাকি সন্ধে বেলায় ঝড় আসবে। খবরে বলেছে। অকালের কালবৈশাখী।
বিছানায় শুয়ে অলোকরঞ্জনের মুখটা মনে পড়ল। যশোমতীকে সে কোনও দিন দেখেনি। আট-দশ মাসের চেনা মুখটা ভাবতে ভাবতে এক সময় মণিজিঞ্জির ঘুমিয়ে পড়ল।
হলিডে কোর্টের ভেতর ওয়াকিং করা যায়। খুব বড় ক্যাম্পাস। পরিচ্ছন্ন রাস্তাটি অ্যাপার্টমেন্ট হাউসকে বৃত্তায়িত করে রেখেছে। বিষণ্ণ মন। বিকেলে ওই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মণিজিঞ্জির ভাবল, এক্ষুনি কি এক বার অলোকরঞ্জনকে ফোন করবে? বিপন্ন মানুষটার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। চৈতালি হাওয়ায় কমপ্লেক্সের বাউন্ডারির ধারে দেবদারুর পাতা কাঁপছে। অকাল কালবৈশাখী আসছে নাকি? অলোকরঞ্জনকে ফোন করল। ফোন বন্ধ। তথাগত কলকাতায় থাকলে তাঁকে নিজের সব কথা বলে হাল্কা হতে পারত। ওইটুকু সময়ের আলাপ। তবুও তাঁকে আপনজন মনে হচ্ছে। কবে কলকাতায় ফিরবেন? বাহাদুর কি ওই অ্যাপার্টমেন্টে আছে? আবার অলোকরঞ্জনকে রিং করল। সুইচ অফ। ছুটে গেল এলিভেটরের দিকে। উঠে এল ছাব্বিশ তলায়। তথাগতর নাম লেখা দরজা বন্ধ। কোলাপসিবল গেটে তালা।
|
চার |
একই ভাবে দিন কাটে। অলোকরঞ্জন ফোন করে না। ওকে ফোনে পাওয়া যায় না। পর পর চারটে দিন। এই উইকে সে নিউ আলিপুরে পড়াতে গেল না। তন্বীকে ফোন করে বলে দিল সে যেন বাকি তিন বান্ধবীকে জানিয়ে দেয় এই উইকে ম্যাম আসতে পারছেন না।
সে দিন সকালে নিজের ঘরে বসে আবার মণিজিঞ্জির লীলা হয়ে গেল। 'ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডের গলি দিয়ে সে একা একা ফিরছে...।' সন্ধ্যারানি এসে বলল, 'বাইরে কে যেন তোমাকে ডাকছে।' মণিজিঞ্জির ছুটে গেল দরজার দিকে। বাহাদুর। বাহাদুর বলল, 'উনি এসেছেন। আপনাকে ডাকছেন।'
ড্রয়িং রুমের সোফায় তথাগত বসেছিলেন। গায়ে টুকটুকে লাল শার্ট। পরনে ঢিলে পাজামা। মুখে মৃদু হাসি, 'বিকেলে শান্তিনিকেতনে যেতে হবে। বিশ্বভারতীতে কাল একটা সেমিনার আছে। অসময়ে ডেকে পাঠালাম। আপনার অ্যাপার্টমেন্টের হদিশ নাথুরাম দিয়েছে।' মণিজিঞ্জির আজ বুঝতে পারল তথাগত কথা বলার সময় খুব কম ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। সে বলল, 'বলুন। কী বলবেন!'
আজ কমলালেবু রঙের ট্রেতে দু'গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ। শরবতের গ্লাস দু'টি রেখে বাহাদুর চলে গেল। দু'জনে শরবতে চুমুক দিল। কয়েক সিপের পর তথাগত বললেন, 'অলোকরঞ্জনবাবুর মোবাইলটা বোধ হয় হারিয়ে গিয়েছে। এর আগে যখন কলকাতায় ছিলাম এক দিন আমাকে ফোন করেছিলেন। কাল রাতে ফিরে ওঁকে কয়েক বার ফোন করলাম। সুইচ অফ। আজ ভোরে উনি ফোন করেছিলেন। মনে হল কোনও বুথ থেকে। কয়েক দিনের মধ্যে ওঁর আঁকা একটি ছবি আপনাকে দিয়ে যাবেন। পুজোর সময় কলকাতায় আসব। তখন ছবিটা নেব। এই চেকটা রাখুন।' পকেট থেকে একটা চেক বার করে মণিজিঞ্জিরের দিকে এগিয়ে দিলেন। মণিজিঞ্জির জিজ্ঞেস করল, 'আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে অলোকরঞ্জনের সঙ্গে কথা হয়েছে?' তথাগত বললেন, 'হ্যাঁ।' সে জিজ্ঞেস করল, 'অলোকরঞ্জনকে চিনতেন?' উনি বললেন, 'না।' মণিজিঞ্জির বলল, 'অলোকরঞ্জন সব কথা বলেছে?' তথাগত বললেন, 'হ্যাঁ।' মণিজিঞ্জির বলল, 'যশোমতীর কথাও!' তথাগত মাথা দোলালেন, 'হ্যাঁ। নিন, চেকটা।' মণিজিঞ্জির মাথা নিচু করে বলল, 'আমি নিতে পারব না।' তথাগত অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অলোকরঞ্জনের বোধ হয় চাকরিটা নেই। ছবি ফেরি করে বেড়াচ্ছে। এই কারণেই সে তাকে ফোন করেছিল। অবরুদ্ধ কান্না অশ্রু বাষ্প হয়ে মণিজিঞ্জিরের দৃষ্টিকে ধূসর করে দিল। সে মুখ তুলল না। কতক্ষণ পরে তুলতে পারবে জানে না।
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|