এ-ও সম্ভব! এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে পিঙ্কি প্রামাণিকের গ্রাম বাঘমুণ্ডির তিলকডিতে।
যে মেয়েকে চোখের সামনে তিলতিল করে বেড়ে উঠতে দেখেছে পুরুলিয়ার এই প্রত্যন্ত গ্রাম, সেই মেয়েকে নিয়ে ‘পুরুষ’ না ‘নারী’ এমন বিতর্ক তৈরি হওয়ায় অবাক বাল্যবন্ধু থেকে পাড়ার ক্লাবের কর্তা সকলেই। তাঁদের দাবি, দ্রুত এই বিতর্কের অবসান হোক এবং চক্রান্ত করে এই অভিযোগ করা হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হোক।
তিলকডির এক সাধারণ লরি চালকের মেয়ে পিঙ্কি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই গাঁয়ের আর পাঁচটা মেয়ের মতো ছিলেন না। শৈশব থেকেই এলাকার শিরোনামে। পাড়ার হেমন্ত বসু ক্লাব ও স্মৃতি পাঠাগারের সম্পাদক হেমকান্ত কুইরি বলেন, “আর পাঁচটা মেয়ে যেমন বাড়ি, পড়াশোনা নিয়ে থাকে, পিঙ্কি একেবারে উল্টো ছিল। বাঁইবাঁই করে শুধু ছুটে বেড়াত তিলকডি থেকে শুরু করে সারিডি, লেংডি, মার্চা, নোয়াডি, রাইডি এলাকায়। লাগোয়া এই গ্রামগুলির সকলেই ওকে ছোট থেকেই ডানপিটে বলেই জানে। কিন্তু এই বিতর্কে আমরা বিস্মিত!”
গ্রাম জুড়ে চাপা ফিসফাস। পিঙ্কির বাড়ির সামনে তিলকডি মোড়ে তাঁর পাড়ার ক্লাবের উল্টো দিকে গাছের তলায় জটলা। বিদ্যুৎ নেই। তাই কাগজ পড়ে কাল ঠিক কী ঘটেছে, কী অভিযোগ জমা পড়েছে সব খুঁটিয়ে পড়ছিলেন লোকজন। পিঙ্কির জেঠতুতো দাদা ধনঞ্জয় কুইরিও ছিলেন সেখানে। তাঁর কথায়, “আগে ওর বাবা লরি চালাতেন। আর আমি ছিলাম খালাসি। খুব ছোটবেলা থেকে দেখেছি, কোলেপিঠে মানুষ করেছি। ও মেয়ে এ নিয়ে কোন সংশয় নেই।” তিনি বলেন, “তবে বছর সাত-আটেক তো ও এখানে থাকে না। কখনও-সখনও দু-একদিনের জন্য ঘুরতে আসে। কিন্তু বলতে পারব না মেয়ে কী করে ছেলে হয়ে যেতে পারে। পুরো ঘটনার তদন্ত হোক।” |
গ্রামের রাস্তায় ছুটতে ছুটতে তাঁদের পিঙ্কি চোখের সামনে স্কুল থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য পেয়েছে। পিঙ্কিকে উঠে আসতে প্রায় পাশ থেকেই সাহায্য করেছেন লাগোয়া সারিডি গ্রামের বাসিন্দা পুরুলিয়ার প্রাক্তন সাংসদ বীরসিংহ মাহাতো। পেশায় পিঙ্কির স্কুলের শিক্ষক বীরসিংহবাবু বলেন, “ওকে অনেককাল ধরেই তো চিনি। ওর শরীরে, চেহারায় ছেলেদের মতো কিছু লক্ষণ রয়েছে, যেমন গলার স্বরে কিছুটা পুরুষালি ভাব। তবে ও মেয়ে--অন্তত আমি এতদিন তাই জানি। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানই শেষ কথা বলবে!”
কথা বলতে বলতে বীরসিংহবাবু জানালেন, একটা সময় লেড়ু, সিলেট আর পিঙ্কি ছিল হরিহর আত্মা। গ্রামে থাকার সময়ে তিন বন্ধু সব সময় এক সঙ্গে থাকত। কেমন ছিল তিন জনের সেই ফেলে আসা দিন। জানতে লেড়ু প্রামাণিককে খুঁজে পাওয়া গেল গ্রামের বাইরে। তিনি এখন সুইসা ফাঁড়ির কর্মী। কাজ থেকে ফিরছিলেন। খানিক গম্ভীর হয়ে বলেন, “ভোরবেলা উঠে আমরা তিন জনে দৌড়তাম। পায়ের সমস্যা থাকায় আমি খুব বেশি ছুটতে পারতাম না। তবে পিঙ্কির আর সিলেটের উৎসাহ ছিল খুব। ও যখন সোনার পদক জিতে আমাকে দেখাল, কত ভাল লাগল।” খানিকটা অভিমান ঝরে লেড়ুর গলায়, “এখন তো ও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। তবে ও তো মেয়েই।” আর এক বন্ধু তিলকডি লাগোয়া তুন্তুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের পাচক সিলেট কুইরির কথায়, “একদিন উৎসাহের বশে জানতে চেয়েছিলাম, তুই ছেলে না মেয়ে। ও আমাকে বলল, ‘আমি মেয়ে।’ অনেকদিন তো দেখা হয়নি। গ্রামে এলে ফের জিজ্ঞেস করব।”
শুক্রবার পিঙ্কির গ্রামের বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল। ডাকাডাকিতে সাড়া না-পেয়ে ক্লাবের সম্পাদককে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে অবশ্য পাওয়া গেল না পিঙ্কির বাবা দুর্গাচরণ প্রামাণিককে। তাঁর দাদা জয়চাঁদ বললেন, “বাবা-মা দুজনেই কলকাতায় গিয়েছেন। ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। বাবা কাঁদছিলেন আর বললেন, ফিরে আসছি।” ফোনে দুর্গাচরণবাবু বললেন, “কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তবে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি!” |