ধৈর্য আর বাকসংযমেই রাইসিনার পথে
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরসিংহ রাও তখন সদ্য দায়িত্ব নিয়েছেন। রাতে নরসিংহের ৯ মোতিলাল নেহরু রোডের বাড়িতে গেলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রিসভায় ‘যোগ্য মন্ত্রী’ কারা হতে পারেন, তার একটি সম্ভাব্য তালিকা দিয়ে এলেন নতুন প্রধানমন্ত্রীকে। সেই তালিকার সুপারিশ মেনেও নিয়েছিলেন নরসিংহ। প্রধানমন্ত্রীকে নিজের হাতে ‘যোগ্যদের’ তালিকা তুলে দিলেও নরসিংহের কাছ থেকে কিন্তু কোনও ফোন পাননি প্রণব। তাঁকে আবার অর্থমন্ত্রী করা হবে, এই আশায় বুক বাঁধলেও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ভবনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেই বাদ পড়ে যান প্রণব! উল্টে সকলকে চমকে দিয়ে অর্থমন্ত্রী করা হয় মনমোহন সিংহকে। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেও সে দিন মুখ খোলেননি প্রণব। অসীম ধৈর্য দেখিয়ে চুপ করে যান। দীর্ঘ কয়েক মাস পরে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বে প্রণবকে নিয়ে আসেন নরসিংহ। পরে বাণিজ্য এবং শেষে বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বও পান তিনি। হয়ে ওঠেন নরসিংহ-মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী রাজনৈতিক জীবনে প্রণববাবুর সবথেকে বড় গুণ হল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। সম্প্রতি সংসদে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে রাগতে দেখা গেলেও পরে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সেই অর্থে অধৈর্য এবং অসহিষ্ণুতা সে ভাবে দেখানওনি প্রণব। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক জীবনে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়া তাঁর অন্যতম বড় ধাক্কা ছিল। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মনোমালিন্যের কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। রাজীব গাঁধীর সঙ্গে ব্যক্তিগত তিক্ততা না থাকলেও রাজীব-ঘনিষ্ঠ মাখনলাল ফতেদার এবং অরুণ নেহরুর খবরদারি মানতে পারেননি প্রণব। সেই ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রণববাবু একাধিক বার জানিয়েছেন, তখন বয়স অল্প ছিল। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সে ভাবে ছিল না। তাই ধৈর্যচ্যুতি হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর। ছবি: পিটিআই
জাতীয় রাজনীতিতে ‘চাণক্য’। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কখনওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় নন তিনি। মমতা বা শরদ পওয়ার কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক দল গড়ে সফল হয়েছেন। কিন্তু প্রণব পারেননি। সনিয়া গাঁধীর জমানায় তাঁকে ইউপিএ-র প্রধানমন্ত্রী করা হবে বলে জল্পনা চললেও শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পান মনমোহন। কিন্তু আগের ভুল আর করেননি। শান্ত ভাবেই দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
খাতায়-কলমে মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হলেও বকলমে ইউপিএ-সরকার চালানোর অনেকটা কৃতিত্বই কিন্তু প্রণববাবুর। যা মানেন বিরোধীরাও। অসুস্থ হয়ে মনমোহনও একবার প্রণববাবুকে ফোন করে বলেন, ‘স্যার, আমার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়েছে। আপনাকেই কিন্তু দেশ চালাতে হবে।’ এবং তা-ই হয়েছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত থাকলেও বর্তমান মন্ত্রিসভা পরিচালনা করেন প্রণববাবুই। এক সময়ে প্রায় পঞ্চাশটি মন্ত্রিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজের মন্ত্রকের পাশাপাশি অন্য মন্ত্রকের ফাইলও আগাগোড়া ‘স্টাডি’ করে আসতে দেখা যায় তাঁকে। তার সঙ্গে রয়েছে শরিক এবং বিরোধী দু’পক্ষকেই সঙ্গে নিয়ে চলতে পারার বিশেষ গুণ। যা একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনেতার থাকা উচিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
গত কয়েক বছর ধরে প্রণববাবু বুঝতে পারছিলেন, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তা বুঝতে পেরেই রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। বিরোধীদের সঙ্গে প্রথম থেকেই ভাল সম্পর্ক রেখে চলার অতীত ইতিহাস রয়েছে তাঁর। সংকীর্ণ রাজনীতি নিয়ে কোনও দিন মাথা না ঘামানোয় প্রায় সবক’টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভাল। ইউপিএ-সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এনডিএ নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজকে তহেলকা-কাণ্ডে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। এনডিএ-জমানায় তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে ‘গ্যাট’ চুক্তির বিষয়ে সব ধরনের সাহায্য করেছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে লালকৃষ্ণ আডবাণীর। প্রণব-কন্যা শর্মিষ্ঠার নাচের অনুষ্ঠানে একাধিক বার দেখা গিয়েছে আডবাণী-পরিবারকে। এমনকী তাঁর বিচক্ষণতার কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন নিয়মিত ভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান প্রণববাবুর কাছে পরামর্শ নিতে দ্বিধা করেননি আডবাণী।
এই সুসম্পর্কের সুবাদেই কিছু বিজেপি নেতা ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে প্রণবকে বোঝান, সনিয়া আপনাকে বিশ্বাস করেন না। কোনও ভাবেই আপনাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না। আপনি বরং বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সমীকরণ মেনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। বিজেপি আপনাকে সমর্থন করবে। বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রণববাবু। এ বারেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ তাঁকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন। সেই প্রস্তাবও এড়িয়ে গিয়েছেন প্রণব।
আসলে রাজীব গাঁধীর আমলে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে যে ভুল তিনি একবার করেছিলেন, তা আর দ্বিতীয় বার করতে চাননি প্রণব। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত কংগ্রেসের মূল স্রোতের বাইরে ছিলেন তিনি। দিল্লিতে গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতেই থাকতেন। সে সময়ে তিনি যে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’ গঠন করেছিলেন, সেই দলের হয়ে ভোটে জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয় তাঁর। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে হাজার ক্ষোভ থাকলেও ভবিষ্যতে দল-বিরোধী কোনও পদক্ষেপ করেননি। ভোটে হারের পর নতুন করে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে
তোলার কাজ শুরু করেন প্রণব। যার পরিণতিতে ১৯৮৯ সালে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের দায়িত্ব রাজীব গাঁধী তাঁর হাতে তুলে দেন।
রাজনৈতিক জীবনে মমতা যেখানে আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সেখানে প্রণব ঠিক উল্টো মেরুতে। বাক্সংযম ও ধৈর্যই তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। এই কারণেই দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দে তাঁকে তুলনা করা হয় চাণক্যের সঙ্গে। তাঁর ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের সরকারি বাসভবনের অফিস ঘরের দেওয়ালে চাণক্যের একটি ছবিও রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র তাঁর অন্যতম প্রিয় বই। প্রণববাবু মনে করেন, ভারতে বহুত্ববাদ আছে এবং সেই প্রেক্ষিতে কৌটিল্যের নীতি আজও প্রাসঙ্গিক। প্রণব-ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, সম্ভবত রাষ্ট্রপতি ভবনেও চাণক্যের ওই ছবিটি নিয়ে যাবেন তিনি।
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রপতি পদটি যে ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাতে প্রণববাবুই এই মুহূর্তে যোগ্য বলে মনে করে রাজনৈতিক শিবিরও। রাষ্ট্রপতি এখন শুধু একটা সাংবিধানিক পদ নয়। বিশ্বের কাছে দেশের হয়ে কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে এখন অনেক বেশি সক্রিয় রাষ্ট্রপতিরা। তা ছাড়া মন্ত্রিসভার সমস্ত ফাইল তাঁর কাছেই আসবে। নিজের অভিজ্ঞতায় আগামী দিনে সরকারকে প্রয়োজনে সঠিক দিশাও দেখাতে পারবেন বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। আর প্রণববাবুর বাক্সংযম। যা তাঁকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্য মাত্রা দেবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইন্দিরা গাঁধী একবার বলেছিলেন, বাক্সংযমের জন্যই তিনি প্রণবকে এত ভালবাসেন। ইন্দিরা মজা করে বলেওছিলেন, ‘প্রণবের মাথায় হাতুড়ি মারলে ধোঁয়া বেরোবে (তখন তিনি পাইপ খেতেন), কিন্তু কথা বেরোবে না!’
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে প্রণববাবু বলেছিলেন, তিনি প্রাতঃভ্রমণ করেন। কিন্তু তাঁর বাড়ির লনটি ছোট। আজ সনিয়া গাঁধী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণার পরে রাইসিনা হিলসের বিশাল চত্বরে প্রণববাবুর প্রাতঃভ্রমণ এখন কি নিছকই সময়ের অপেক্ষা?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.