|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
‘ভারতনগর’ শ্রেষ্ঠ আসন লবে |
সেখানে গড়ে উঠবে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। তৈরি হবে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, এক্সপ্রেসওয়ে।
দরকারে ঘটবে খুন। দিবাকর যথার্থ রাজনৈতিক ছবি বানিয়েছেন। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
এই ছবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দু’জনেরই দেখা উচিত। বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা বা এসইজেড তৈরি নিয়ে ছবি, প্রগতি মানে মানুষজনকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে শপিং মল তৈরি কি না সেই প্রশ্ন বারে বারেই এসেছে। ছবির মুখ্যমন্ত্রী চরিত্রটি মহিলা (সুপ্রিয়া পাঠক)। তার ওপর পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘বুম্বা’ প্রসেনজিৎ...দুই বাঙালি ছবির অন্যতম কারিগর। ফলে ‘খোকাবাবু’র পাশাপাশি এই ছবি দেখতে মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি থাকা উচিত নয়।
অন্য দিকে এই ছবি গ্রিস থেকে নির্বাসিত কমিউনিস্ট লেখক ভাসিলিস ভাসিলিকোসের ‘জেড’ উপন্যাস অবলম্বনে, কোস্টা গাভ্রাসের মতো পরিচালকও এই কাহিনি নিয়ে ছবি করে ১৯৬৯ সালে অস্কার পেয়েছিলেন। ফলে বুদ্ধদেববাবুও এই ছবি দেখলে ধর্মভ্রষ্ট হবেন না।
তবু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: রাজনীতিকরা এই ছবি দেখলে অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন। বলিউডে সেই ‘আজকা এমএলএ’ থেকে হাল আমলের ‘রাজনীতি’, ‘আরক্ষণ’ কোনওটাই রাজনৈতিক ছবি নয়। স্রেফ রাজনৈতিক চরিত্র বা ঘটনার ওপর কল্পনার মশলা ছড়িয়ে দেওয়া।
দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম কৃতিত্ব, তিনি ক্ষমতার লড়াই, কর্পোরেট লবি-রাজনৈতিক জাল, রাজনীতিতে লুম্পেনদের ব্যবহার সব কিছু আত্মস্থ করে একটি ‘যথার্থ রাজনৈতিক ছবি’ তৈরি করেছেন। ছবির শেষে বেরোতে বেরোতে দেখলাম, এক তরুণী তাঁর সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ছবিটার নাম সাংহাই কেন?’ ভদ্রমহিলাকে বলা হল না, চিনের ইয়াংসে নদীর মোহনায় সাংহাই পৃথিবীর বৃহত্তম ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’। দিবাকর দেখিয়েছেন, যেখানেই ‘সাংহাই’ তৈরি হোক না কেন, কর্পোরেট লবি-রাজনীতির আঁতাত থাকবে, মানুষজন ভিটেছাড়া হবে এবং কার উন্নয়ন, কীসের উন্নয়ন সেই প্রশ্ন উঠবে। সোজা কথায়, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ যে রকম বাংলা সাহিত্যে প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস (‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’ সত্ত্বেও), দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাংহাই’ও সে রকম মূল ধারার বলিউডে প্রথম রাজনৈতিক ছবি। |
|
সাংহাই
প্রসেনজিৎ, অভয়, ইমরান, কোলকি |
আর এই রাজনৈতিক চেতনা তৈরিতে কোস্টা গাভ্রাসের ছবি নয়, বরং তাঁকে আরও বেশি সাহায্য করেছে ভাসিলিস ভাসিলোকিসের উপন্যাস। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ভাসিলিসের উপন্যাস এবং কোস্টা গাভ্রাসের ছবি দুটিই ষাটের দশকে গ্রিসের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে, পরমাণু অস্ত্র সংবরণের দাবিতে। কোস্টা গাভ্রাসের ছবিতে ফরাসি নায়ক ইয়ুভস মন্তাদ ছিলেন বামপন্থী রাজনীতিকের চরিত্রে। ছবিতে ছুটন্ত ট্রাক থেকে এক জন তাঁকে মাথায় লোহার রড মেরে খুন করে।
সেই ইয়ুভস মন্তাদের চরিত্রে এখানে প্রসেনজিৎ, তাঁর চরিত্রের নাম ডক্টর আহমদি। পরমাণু অস্ত্র বিরোধিতা নয়, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা তৈরির বিরোধিতা। সাদা পোলোনেক পরে বিমান থেকে প্রসেনজিৎ নেমে আসছেন। প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী, কিন্তু বিমান থেকে নেমে প্রথমেই পরিচিতা পেজ থ্রি নায়িকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে কথা বলেন। দু’ একটি ফ্রেমেই দর্শক বুঝতে পারে, বামপন্থী এই সমাজকর্মী জানেন, কী ভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হয়!
প্রসেনজিৎ বিমান থেকে নেমে আসছেন দুপুরবেলায়। এবং, দিবাকরের ছবিতে শুধু এই দৃশ্যটিই দিনের আলোয়। বাকি ছবিতে কেবল রাতের অন্ধকার। দিনের শেষেই ডক্টর আহমদির সভা, রাতের অন্ধকারে চলন্ত ট্রাক পিষে দেয় তাঁকে। কোস্টা গাভ্রাসের ছবিটা ছিল ‘রাজনৈতিক থ্রিলার’, ষাটের দশকে ইউরোপ, আমেরিকায় তখন খুনের রাজনীতি। গ্রিসে সামরিক শাসকদের হাতে খুন হয়েছেন উপপ্রধানমন্ত্রী গ্রিগোরিস লাম্ব্রাকিস। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট কেনেডি থেকে জুনিয়ার মার্টিন লুথার কিং, ম্যালকম এক্সও আততায়ীর হাতে হত। অন্য দিকে ভাসিলির উপন্যাসে রাজনৈতিক থ্রিলারের পাশাপাশি ছিল গ্রিসের মানুষের অসহায় আর্তনাদ। দিবাকরের মুন্সিয়ানা সেখানেই। ভারতনগরের জীবনে ‘রাত কত হল, উত্তর মেলে না’ প্রশ্নটাই যে সব, সেটি অক্লেশে তুলে ধরেছেন।
কোস্টা গাভ্রাসের ছবিতে সরাসরি জায়গাটির নাম বলা হয়নি, কিন্তু দিবাকর আরও ঝাঁজালো। যেখানে ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস পার্ক’ তৈরি হবে, তার নাম ভারতনগর। এই দেশ, তার উচ্ছৃঙ্খল নগরায়ণ...সব কিছুই একটি নামে ধরে দিয়েছেন তিনি।
প্রসেনজিতের চরিত্রটি মাত্র কয়েক মিনিটের। কিন্তু ভাল পরিচালক এবং ভাল অভিনেতার জুড়ি সব সময়েই দেখার মতো। ছবিতে প্রসেনজিৎ এবং কোলকি কোয়েকলিনের একটি ‘লিপ লক’ রয়েছে। রান্নাঘরে চায়ের জন্য গরম জল ফুটছে, প্রসেনজিৎ পাশের ঘর থেকে দেখেন, কোলকি শুধু হাতে সেই ফুটন্ত জলের সসপ্যান ধরে, সিঙ্কে ছুড়ে দেন। শিক্ষক ছুটে আসেন ছাত্রীর কাছে। এই যে শুধু হাতে গরম জলের সসপ্যান ছুড়ে দেওয়া, এটাই বুঝিয়ে দেয়, কোলকির চরিত্র তীব্র প্যাশন-আতুর। যে রাগ, ঘেন্না, ভালবাসা থেকে সে গরম জলে হাত দিতে পারে, সেই একই অনুভূতি নিয়ে সে প্রতিবাদের মাঠে নামতে পারে, চুমু খেতে পারে! দিবাকর কয়েকটি আঁচড়েই চরিত্র তৈরি করে দেন। |
|
ছবির সেরা চরিত্র অবশ্য ইমরান হাশমি। পর্ন সিনেমার ফটোগ্রাফার, ছবি তুলতে গিয়ে তাঁর ভিডিওতে আচমকা একটি সূত্র চলে এসেছে। ডক্টর আহমদিকে খুনের চক্রান্ত করেছিল কারা! দাঁতে পানের ছোপ, পর্ন ছবি তোলার জন্য মেয়েদের পটানো, তার মধ্যেই প্রশাসনের হাতে খুনের প্রমাণ দিতে চাওয়া, কোলকিকে সাহায্য করা...‘সিরিয়াল কিসার’ হওয়ার অভিশাপ থেকে এত দিনে মুক্তি পেলেন তিনি! ভোলা যাবে না ‘ভাগ্গু’ চরিত্রে পীতবাসকেও। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নির্বোধ সঙ্গী। ‘ভারতমাতাকি জয়’ গানে পীতবাস এবং ইমরানের নাচ দেখার মতো!
অভয় দেওলও অসাধারণ! নির্ভরযোগ্য আই এ এস অফিসার, তাঁর হাতেই মুখ্যমন্ত্রী আহমদি খুনের তদন্তভার দিয়েছেন। চশমা এবং টাই ঠিকঠাক না থাকলে এই আমলার আত্মবিশ্বাস আসে না। আহমদিকে খুনের চেষ্টার দিন থানা অভিযোগ নেয়নি কেন? তাঁর ওপরওয়ালা মুখ্যসচিব ফারুক শেখ কেন তদন্ত ছাড়াই রিপোর্টে ‘পুলিশি গাফিলতি’ লেখার জন্য চাপ দিচ্ছেন? বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ফারুক কেনই বা টেন্ডার ছাড়া একটি সংস্থাকে জমি দিয়েছেন? ভাসিলির উপন্যাসকে ভিত্তি করে দিবাকর কতকগুলি প্রাসঙ্গিক (ভারতীয়) প্রশ্ন তুলে দেন। এখানেই মুন্সিয়ানা।
দিবাকরের অন্যতম কৃতিত্ব, তাঁর মুখ্যমন্ত্রী চরিত্রটি মহিলা। এবং কেন্দ্রের জোট সরকারের শরিক। এই চরিত্র মমতা না মায়াবতী, জয়ললিতা না শীলা দীক্ষিত কাকে নির্ধারণ করছে, সেই প্রশ্ন বাতুলতা। দিবাকর শেষ দৃশ্যে যা দেখিয়েছেন, তার মর্মার্থ, ক্ষমতার কোনও নারী-পুরুষ লিঙ্গবিভাজন নেই। সে সর্বত্র একই ভাষায় কথা বলে।
ডক্টর আহমদির স্ত্রীর চরিত্রে তিলোত্তমা সোম যেমন! স্বামীকে সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকাটা ব্যবহার করেন, প্রতিবাদ করে পরের বার মুখ্যমন্ত্রী বনে যান। শেষ দৃশ্যে তাঁরই কাট-আউটের নীচে বুলডোজার ধেয়ে আসে, সামনে জ্যান্ত হয়ে-ওঠা আহমদি। লঙ্কায় যে যায়, সেই হয় রাবণ! তবু জনজীবনে প্রতিবাদ চলে, চলবে। এটাই রাজনীতি!
দিবাকর জনজীবনের সেই জটিল আবর্তকে পরতে পরতে তুলে ধরেছেন। নেহাৎ মুখ্যমন্ত্রীর ঘর অত ছোট হয় না, তাই এক নম্বর কেটে নেওয়া হল। |
|
|
|
|
|