|
|
|
|
শিয়রে পুর-নির্বাচন, ঝাড়গ্রামে বোর্ড রক্ষার লড়াই বামেদের |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
আগামী বছর জোড়া পুরভোট পশ্চিম মেদিনীপুরে। জেলা-সদর মেদিনীপুরে ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই যেখানে তৃণমূল ও কংগ্রেসের, হবু জেলা-সদর ঝাড়গ্রামে সেই লড়াই বামেদের (বর্তমান ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লক ও ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকা নিয়েই পৃথক জেলা গঠনের তোড়জোর চলছে)। বাকি রাজ্যের সঙ্গেই ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলেও বিপর্যস্ত বামেদের কাছে ঝাড়গ্রাম-রক্ষা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রায় তিন দশক ধরে, সেই গোড়াপত্তনের সময় থেকেই, ঝাড়গ্রাম পুরসভায় টানা ক্ষমতায় রয়েছে বামেরাই। বাম-পুরবোর্ডের কাছে পুরবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ বিরোধী তৃণমূলের। ১৯৮২ সালে প্রথম মনোনীত পুর-বোর্ড ছিল বামেদের। এরপর ১৯৮৮, ’৯৩, ’৯৮, ২০০৩ ও ’০৮-এ পর পর পাঁচটি পুরভোটে জিতে ক্ষমতা পেয়েছিল বামেরা। পরের পর পুরভোটে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামেদের ইস্তাহারে পুর-শহরে পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে নদীভিত্তিক জল-প্রকল্প গড়া, সুষ্ঠু-নিকাশির জন্য মাস্টারপ্ল্যানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি বলেই অভিযোগ। পুর-পরিষেবা ঘিরে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে নাগরিকদের। তাই পুরভোটের এক বছর আগে অস্বস্তি বেড়েছে বামেদের। বাম পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু, রাজ্যে নতুন সরকারের বয়স মাত্রই এক বছর। বাম-জমানার দীর্ঘ তিন দশকে কেন পুর-শহরে আশানুরূপ কাজ করা গেল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা এবং পুরবাসীর একাংশ। |
|
উপ-পুরপ্রধানের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বেহাল রাস্তা। |
ঝাড়গ্রাম পুর-শহরে সাড়ে ৬১ হাজার মানুষের বাস। জনসংখ্যার নিরিখে পানীয় ও নিত্য-ব্যবহার্য মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ লক্ষ গ্যালন জল প্রয়োজন। অথচ, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সহযোগিতায় শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ৭৬০টি টাইমকলের মাধ্যমে দৈনিক মাত্র ১ লক্ষ ৬০ হাজার গ্যালন জল সরবরাহ করে পুরসভা। বহু টাইমকলে আবার ঠিকমতো জল আসে না। পানীয় জলের মান নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। গ্রীষ্মে সরকারি গভীর নলকূপগুলির কয়েকটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় জল-সঙ্কট বাড়ে। অভিযোগ, শহরের যত্রতত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগেও গভীর নলকূপ হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাচ্ছে বিপজ্জনক ভাবে।
শহরের দক্ষিণ-প্রান্তের চেয়ে উত্তর-প্রান্ত ৫৫ ফুট নিচু। অতিবৃষ্টিতে শহরের নিচু এলাকার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে জল জমে। শহরে যেখানে ন্যূনতম একশো কিমি দীর্ঘ নয়ানজুলি থাকার কথা, সেখানে সব মিলিয়ে রয়েছে মাত্রই ২৭ কিমি দীর্ঘ নয়ানজুলি। পুর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, মাস্টারপ্ল্যান কার্যকর করতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। ‘ডি’-ক্যাটাগরির ঝাড়গ্রাম পুরসভার পক্ষে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য রাজ্য সরকারের বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন। এলাকা-ভিত্তিক নয়ানজুলি ও বড় নর্দমা তৈরি করে নিকাশির উন্নয়ন-কাজ চলছে বলে দাবি পুর-কর্তৃপক্ষের।
১৭টি ওয়ার্ড-বিশিষ্ট ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকার আয়তন ২১ বর্গ কিলোমিটার। শহরের মোট ২২০ কিমি রাস্তার মধ্যে মাত্র ৫২ কিমি রাস্তা পিচের। ১২ কিমি রাস্তা কংক্রিটের, ৮১ কিমি রাস্তা মোরামের এবং বাকি ৭৫ কিমিই মাটির। বেশ কিছু এলাকায় এখনও পথবাতির ব্যবস্থাটুকুও নেই। হবু জেলা-সদরের এই হাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেই বামেদের বিঁধছেন পুরসভার বিরোধী কাউন্সিলর তৃণমূলের প্রশান্ত রায় ও শিউলি সিংহ এবং প্রাক্তন কাউন্সিলর তৃণমূলের তপন সিংহরা। তাঁদের অভিযোগ, “একটানা ক্ষমতায় থেকে বাম-পুরবোর্ড শুধু স্বজনপোষণ ও স্বেচ্ছাচার চালিয়েছে। রাস্তাঘাট, বস্তি-উন্নয়ন, নিকাশি ও জল-সমস্যা মোকাবিলায় পুরবোর্ড চূড়ান্ত ব্যর্থ। ন্যূনতম পরিষেবা পান না পুরবাসী।” |
|
১৭ নম্বর ওয়ার্ডে খারাপ হয়ে যাওয়া কল। |
পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, পুরকর-বাবদ বার্ষিক ৫২ লক্ষ টাকা আয় হয়। ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য কর-বাবদ আয় বছরে আরও ১৪ লক্ষ টাকা। অথচ, পুর-পরিষেবা দিতে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ বলে দাবি পুর-কর্তৃপক্ষের। অস্থায়ী কর্মীদের বেতন দিতেই বছরে খরচ ৬০ লক্ষ টাকা। পুর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশির এই অবস্থায় এতদিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ অনুদানে ঘাটতি পুষিয়ে যেত। কিন্তু, রাজ্যে তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘কপাল পুড়েছে’ ঝাড়গ্রাম পুরসভার। পুরপ্রধান সিপিএমের প্রদীপ সরকারের দাবি, “গত মার্চে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের আশ্বাস দেন। শহরের রাস্তা সংস্কারের জন্য পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদাও আশ্বাস দিয়েছিলেন। জঙ্গলমহলের অন্যান্য পুরসভাগুলি অর্থসাহায্য পেলেও আমারা এখনও ব্রাত্যই থেকে গিয়েছি।” কৌশলে ঝাড়গ্রাম পুরসভাকে হেয় করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন পুরপ্রধান। শহুরে কর্ম-সুনিশ্চিত প্রকল্পের আওতায় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করে এতদিন জঞ্জাল পরিষ্কার, বিভিন্ন পার্ক রক্ষাবেক্ষণ, ডিপ-টিউবওয়েলগুলি চালানো এবং যানজট মোকাবিলার যে কাজ চলছিল, প্রকল্পের টাকা বন্ধ হওয়ায় ওই সব কাজও ব্যাহত হচ্ছে বলে পুরপ্রধানের দাবি।
এই চাপানউতোরের বাইরে পুরবাসীর প্রত্যাশা নাগরিক-স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিষেবার মানোন্নয়ন।
|
ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
|
|
|
|
|