সেটপিস মুভমেন্ট থেকে কেন ইউরোয় বেশি গোল হচ্ছে না, তা নিয়ে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের নানা টুকরো-টাকরা মন্তব্য মিডিয়ায় বা ইন্টারনেটে চোখে পড়ছিল। কেউ বলছেন, ভাল ফ্রিকিক মারার লোক কমে গিয়েছে। আবার কারও বক্তব্য, বক্সের ঠিক বাইরে বেশি ফ্রিকিকই হচ্ছে না। দ্বিতীয়টার কথা বলা কঠিন, কিন্তু ফ্রিকিক স্পেশালিস্ট কমে গিয়েছে মানতে পারলাম না। সেরা নমুনা অবশ্যই ইতালির আন্দ্রে পির্লো। এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর ফ্রিকিক স্পেশালিস্ট। বক্সের ঠিক বাইরে যে জায়গাটায় ফ্রিকিক পেয়েছিল ইতালি, সেটাকে স্বচ্ছন্দে ‘পির্লো জোন’ বলে ডাকা যায়। ফ্রিকিকটা যখন পেল, তখনই খেলা দেখতে দেখতে আমি আমার পাশে বসা এক বন্ধুকে বললাম, নিশ্চিত গোল। হলও তাই। ইতালির লিগ সিরি এ-তে ওই জায়গা থেকে ফ্রিকিকে অসংখ্য গোল করেছে পির্লো।
এ বারের ইউরোয় সেটপিসে করা সেরা গোল। ছ’জনের ওয়াল টপকে বলটা যে ভাবে গোঁত্তা খেয়ে গোলে ঢুকল, পৃথিবীর কোনও গোলকিপার বাঁচাতে পারত না। অথচ টিভিতে দেখলাম জনৈক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার বলটাই দেখতে পায়নি এবং বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া ফ্রিকিকের ক্ষেত্রে ফুটবল আইন বদলানোর কথা ভাবা যেতে পারে। কারণ সামনে পাঁচ-ছ’জনের ওয়াল থাকলে অনেক সময়ই গোলকিপারের পক্ষে বল দেখা সম্ভব হয় না। আর সেটা যে ফ্রিকিক মারছে, তার কাছে ‘আনফেয়ার অ্যাডভান্টেজ’ হয়ে দাঁড়ায়। এই যুক্তি মানতে পারলাম না। গোলকিপার যাতে ‘আনসাইটেড’ না হয়ে যায়, সেটা তো যারা ডিফেন্স করছে তাদেরই ঠিক করতে হবে। যে মারল, সে যে ওয়াল টপকে বলটা ঠিক জায়গায় উপযুক্ত কোণে রাখল, সেটা তো অসামান্য স্কিলের ফসল। এখানে আইন বদলানোর ভাবনাটাই হাস্যকর। আমার কাছে পির্লোর ফ্রিকিকটা অবশ্যই স্বপ্নের মুহূর্ত। |
আর দ্বিতীয় স্বপ্নের মুর্হূতটা তৈরি হল ক্রোয়েশিয়ার গোলের সময়। প্রথমার্ধে ০-১ পিছিয়ে থাকা টিমটা দ্বিতীয়ার্ধে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিল। এই ইতালি ইউরোর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ১০টা ম্যাচে মাত্র দুটো গোল খেয়েছিল। ওদের চিরাচরিত সেই নীত—গোল করি বা না করি, গোল খাব না। সেই ইতালির ডিফেন্সকে দ্বিতীয়ার্ধে নড়বড়ে লাগল ক্রোয়েশিয়ার উজ্জীবিত ফুটবলের সামনে। গোলটার কথা ভাবুন। বাঁ দিকের উইং থেকে স্ট্রিনিচের প্রায় গজ তিরিশের লম্বা ক্রসটা বুঝতেই পারল না ইতালির চেলিনি। বল এসে পড়ল বক্সের মধ্যে ওত পেতে থাকা স্ট্রাইকার মান্ডজুকিচের পায়ে। বুফোঁর কিছু করার ছিল না।
ইতালির দুটো পয়েন্ট দরকার ছিল, ক্রোয়েশিয়ার ড্র হলেও চলত। সে দিক দিয়ে দেখলে প্রানদেলির টিমকে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। ইউরোয় দুটো ম্যাচ হয়ে গেল, জয় নেই। সঙ্গে দুটো ম্যাচে দুটো গোলও খেতে হয়েছে। ম্যাচ যখন চলছে, স্যর অ্যালেক্স ফাগুর্সনের একটা মন্তব্য মাথায় চলে আসছিল। স্যর অ্যালেক্স বলেছিলেন, “একটা ভাল গোলকিপার। আর একটা ভাল স্ট্রাইকার। এই দু’টো থাকলে বাকিটা করে নিতে খুব বেশি অসুবিধে হয় না।”
এক কথায় অতি সরলীকরণমনে হতে পারে, কিন্তু ফুটবলের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, স্যর অ্যালেক্সের কথায় কোথাও একটা সারবত্তা আছে। নিজে কোচিং করাতে গিয়ে বারবার দেখেছি, ভাল স্ট্রাইকার ছাড়া আপনি লম্বা লিগ বা বড় টুর্নামেন্ট জিততে পারবেন না। এ বারের ইউরোয় ভাল গোলকিপিং রোজই দেখছি। প্রায় প্রত্যেকটা টিমেই অভিজ্ঞ গোলকিপার, উন্নত মানের সেভও দেখা যাচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ হতে চলল ভাল স্ট্রাইকার বলতে দেখলাম, জার্মানির মারিও গোমেজ আর ইউক্রেনের বুড়ো ঘোড়া শেভচেঙ্কো। তা হলে কি ইউরোপের ফুটবলে স্ট্রাইকারের আকাল পড়ল? |
ইতালির কথাই ধরা যাক। দাভিদ ভিয়া না থাকায় স্পেন যেমন স্ট্রাইকার সমস্যায় আগের দিন ভুগছিল, ক্রোয়েশিয়া-ইতালি ম্যাচেও দেখলাম তাই হচ্ছে। ইতালি ফুটবলের ট্র্যাডিশন যদি দেখেন, ভাল স্ট্রাইকারের অভাব চার বারের বিশ্বজয়ীদের কোনও দিন হয়নি। তা ৮২-র বিশ্বকাপে পাওলো রোসি হোক বা নব্বইয়ের বিশ্বকাপে স্কিলাচি। বাজ্জিও, দেল পিয়েরো বা ভিয়েরিদের কথাও বলতে হবে। এরা ইতালি ফুটবলের সোনার ছেলে। সেই তুলনায় বালোতেলি এদের অর্ধেকও নয়। ওর ফর্ম আসা-যাওয়াটা অনেকটা টি শার্ট বদলানোর মতো। ভীষণ খামখেয়ালি। ও নিজেও জানে না কখন ভাল খেলবে, কখন ডোবাবে। স্পেনের সঙ্গে গত ম্যাচটাতে ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে পারেনি। তার পর আবার গ্যালারি থেকে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যের অভিযোগও করেছে। এ দিনও দেখলাম, প্রথমার্ধে দু’টো ভাল সুযোগ পেয়েও গোল তুলতে পারল না। একটা শট সোজাসুজি মারল গোলকিপারকে তাক করে। আর একটা বেরিয়ে গেল বাইরে।
সামনে বালোতোলি আর কাসানোকে রেখে ৩-৫-২ ছকে খেলছিল ইতালি। দুই স্ট্রাইকারও গোলের সুযোগ পেয়ে ব্যর্থ। যা দাঁড়াল, পরের আয়ার্ল্যান্ড ম্যাচ না জিতলে ইতালির ইউরো অভিযান শেষ হয়ে যেতে পারে।
|
ভাগ্য ঝুলে চার দলেরই |
• মরণ গ্রুপে এখনও নিশ্চিত নয় জার্মানির ভাগ্য। শেষ ম্যাচে জার্মানি যদি ডেনমার্কের কাছে বড় ব্যবধানে হারে এবং পর্তুগাল যদি নেদারল্যান্ডসকে হারায় তা হলে বিদায় নেবে জার্মানি।
• নেদারল্যান্ডসের ইউরোও এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ডেনমার্ক যদি শেষ ম্যাচে জার্মানির কাছে হারে এবং নেদারল্যান্ডস দু’গোলের ব্যবধানে পর্তুগালকে হারায়, তা হলে গ্রুপ অব ডেথ থেকে শেষ আটে যাবে জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডস।
• পর্তুগাল যদি নেদারল্যান্ডসকে হারায় আর ডেনমার্ক হারে বা ড্র করে জার্মানির সঙ্গে, তা হলে পরের রাউন্ডে চলে যাবেন রোনাল্ডোরা। পর্তুগাল-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ ড্র হলেও যেতে পারবেন রোনাল্ডোরা, যদি ডেনমার্ক ম্যাচ হেরে যায়।
• ডেনমার্কের সামনেও সুযোগ থাকছে। জার্মানিকে হারাতে পারলে আর পর্তুগাল শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ড্র করলে পরের রাউন্ডে যাবেন ড্যানিশরা। |
|