নিজস্ব সংবাদদাতা • মহম্মদবাজার |
সংসার চলে কোনও মতে। মা পরের জমিতে দিনমজুরি করেন। আর্থিক সম্বল না থাকায় ভাইয়েরাও অল্প বয়সেই পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে। পেট চালাতে তারা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু এই মেয়ে জেদ ধরে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে দিয়েছে। এমনও হয়েছে ছুটির দিনে তাকে দিনমজুরি খাটতে হয়েছে। সেই টাকা তার পড়াশোনার সাহায্যে এসেছে। প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে আজ সেই মেয়ে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী মহম্মদবাজারের অজপাড়া গ্রাম ভাগাবান্ধের মুখ উজ্জ্বল করেছে। স্থানীয় বলিহারপুর হাইস্কুল থেকে এ বারে মাধ্যমিকে চম্পা মারান্ডি পেয়েছে ৪৬২ নম্বর।
|
চম্পা মারান্ডি। |
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর কয়েক মাস আগেই মারা গিয়েছেন চম্পার বাবা কালিদাস মারান্ডি। বাবাকে রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখা এই মেয়ের স্বপ্ন তাই ডাক্তার হওয়া। কিন্তু চম্পার সেই স্বপ্ন বোধহয় অধরায় থেকে যাবে। যার প্রধান কারণ পরিবারের আর্থিক অনটন। তাই লড়াইয়ের নতুন পথ খুঁজছে চম্পা।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চম্পাই বড়। চম্পার পরের ভাই বাবলু বলিহারপুর হাইস্কুলেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। অর্থের অভাবে পড়া ছেড়ে দিয়ে এখন পরের বাড়িতে কাজ করে। চার নম্বর ভাই সোমনাথ দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ছোট বোন চামেলিও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে, একই কারণে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর ছোট ভাই রাজেন এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। বছর আটেকের সোমনাথও অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সংসারের অভাবের কথা জানিয়ে মা দিবানী মারান্ডির জিজ্ঞাসা, “আমাদের কি লেখাপড়া করার স্বপ্ন দেখা সাজে?” তিনি জানালেন, বাধ্য হয়ে বড় মেয়ে চম্পাকে অনেকবার বলেছেন লেখাপড়া ছেড়ে তাঁর সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করতে। কিন্তু চম্পা সে কথা শোনেনি। স্কুল ছুটিতে মাঝেমধ্যে অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে নিজের পড়াশোনার খরচা চালিয়ে নেয়। দিবানীদেবীর চিন্তা, “শুনছি এরপরে পড়তে প্রচুর খরচ। জেদের বশে ১০ ক্লাস পাশ করল ঠিকই, কিন্তু এ বার কি হবে?”
ছলছল চোখে চম্পা জানায়, বাবাকে একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখে মনে মনে ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে ডাক্তার হব। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে গরিব লোকেদের চিকিৎসা করব। কিন্তু এই আর্থিক অবস্থায় ওই স্বপ্ন দেখা চম্পা ছেড়ে দিয়েছে। তাঁর লক্ষ্য একটু পাল্টেছে। আর এই নতুন লক্ষ্যই, তার নতুন লড়াই। চম্পার কথায়, “স্কুলে পড়িয়ে এলাকার ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করাটাই এখন আমার স্বপ্ন।” কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব। চম্পা তাই এখন কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য চাইছে। চম্পা বলে, “আমার মা ভাইবোনেরা কতদিন আর দিনমজুরি করে আমাকে পড়াবে? কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে আমাদের মতো মেয়েরা স্বপ্ন দেখবে কীভাবে?”
কোনওদিনই কোনও গৃহ শিক্ষক ছিল না তার। স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতাতেই সে পড়াশোনা চালিয়ে এসেছে। তবে পরীক্ষার আগে কয়েকমাস এলাকার এক দুঃস্থ যুবকের কাছে পড়েছে। অঙ্ক ও ইংরেজি-সহ অন্যান্য বিষয়গুলি তিনিই দেখিয়ে দিতেন। দিনমজুরির উপার্জন থেকে কোনওরকমে ওই শিক্ষককে সামান্য কিছু টাকাও দিয়েছে সে। চম্পার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৈনাক দে বলেন, “আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস চম্পা সত্যিকারের সুযোগ সুবিধা পেলে শুধু জেলা নয়, রাজ্যের মধ্যেও আরও ভাল ফল করতো।” সেই চম্পার এখন দুশ্চিন্তা, “সত্যিই কি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব? না কি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে অন্যদের মতো আমাকেও বসতে হবে বিয়ের পিড়িতে?”
যতই যা হোক, মা কিন্তু চান মেয়ে লড়াই চালিয়ে যাক। চোয়াল কঠিন করে বললেন, “মেয়ে নিজের ইচ্ছায় এতটা পড়েছে। তার স্বপ্ন বাস্তব করতে আমরা দিনরাত কাজ করব।” |