এই রাজ্যেই বাড়িওয়ালারা সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছেন। বাড়িওয়ালা মানেই শোষক,
আর ভাড়াটে শোষিত, এই ধারণাটির আজ আর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। লিখছেন
সুগত মারজিৎ |
ধরুন, আপনি এক জন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত বাড়িওয়ালা হ্যাঁ, বাড়িওয়ালারা শোষক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত না-ই হতে পারেন। যেমন, যে অটোচালক পুলিশ সার্জেন্টকে খোলা রাস্তায় চপেটাঘাত করেন, তিনি ‘শোষিত’ বলে পার পেতে পারেন না। আপনার বাড়ির ভাড়াটে, যিনি আজীবন কলকাতার একটি জনপ্রিয় বিলাসবহুল জায়গায় মাসে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে আসছেন, এমন কেউ বিত্তশালী হবার সুবাদে অন্য কোথাও ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন। কিন্তু ওই ১০০ টাকার ঘরটি ছাড়লেন না। এমন উদাহরণ কিন্তু বাস্তব। তা হলে ওই ঘরটি ‘ভাড়াটে’ মালিক এবং প্রকৃত মালিকে এক বিশাল ফারাক হয়ে গেল। ফলে ঘরটি কার্যত অনাথ হয়ে গেল। কম ভাড়া পেলে প্রকৃত মালিকের সেই বাড়ি-ঘর সম্পর্কে তেমন উৎসাহ থাকার কথা নয়। আর যিনি ভাড়া আছেন, তিনিই বা দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ করবেন কেন?
কলকাতা শহরে প্রচুর নতুন বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। হয়তো অনাবাসী সচ্ছল স্থানীয় মানুষজনও দীর্ঘমেয়াদি, কম ঝুঁকির এবং বেশি লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে বাড়ি কেনেন এবং অনেক সময়ই ফেলে রাখেন। ভয়ে ভাড়াটে বসাতে চান না, যদি না ওঠে! অন্য দিকে, অনেক ভদ্রজনই হয়তো ভাল বাড়ি ভাড়া চাইতে পারেন, কিন্তু তাঁরাও ভাড়া পাবেন না, ফলে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। |
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গতেই এমন সমস্যা বেশি। নিজের বাড়ি বা ঘর উদ্ধারে আদালতে গেলে এক-দেড় দশক হামেশাই কেটে যায়। ভারতের অন্য কোনও বড় শহরে আইনি ব্যবস্থা অনেক দ্রুত কার্যকর হয়। এখানে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যানধারণা এবং জনমানসে প্রোথিত অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে। তার বলি হচ্ছেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত বাড়িওয়ালা।
ধ্যানধারণাগুলো খানিকটা এই রকম:
১) বাড়িওয়ালা বড়লোক, ভাড়াটে গরিব। স্বামী-পুত্রহীন অনেক গরিব বিধবা মহিলা বাড়িওয়ালা হতেই পারেন, তাঁকে শোষণ করছে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত ভাড়াটেরা। আমার এক প্রয়াত বন্ধু ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। সেই দলেরই সভ্য তাঁর এক ভাড়াটে তাঁকে সারা জীবন অত্যাচার করেছে দলেরই মদতে। তিনি অর্থাভাবে কোর্টে যেতে পারেননি।
২) কলকাতা পুরসভা কর বাড়িয়ে চলেছে। বাড়িতে ব্যবসা করছেন ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা বর্ধিত হারে কর দেবেন, কিন্তু ভাড়া বাড়াতে গেলে, ভাড়াটে ন্যায্য ভাড়া না দিলে ঘর উদ্ধার করতে আদালতের দরজায় হত্যে দিতে হবে, কারণ বাড়িওয়ালা শোষক, ভাড়াটে শোষিত।
৩) জবরদখলি জমিকে আইনানুগ করে বিলিয়ে দেবার পক্ষে কথা বলার লোক প্রচুর। কিন্তু বড় কষ্ট করে নিজেদের সব সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি করে, তার দুটো ঘর ভাড়া দিতে মানুষ যখন ভয় পায়, তাঁর পাশে দাঁড়াবার লোক নেই।
৪) কোনও এক সময় নিশ্চয় যাঁরা ভাড়া থাকতেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জোয়ারে প্রথম প্রজন্মের ভাড়াটের চেয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাড়াটে অনেক সচ্ছল। অনেক ক্ষেত্রেই ভাড়াটে বাড়িওয়ালার চেয়ে বড়লোক, তবুও এ রাজ্যের আইন তা প্রকৃতপক্ষে মানতে চায় না। বাড়ির বর্ধিত মূল্য লাগু করে কর বসাতে সরকার সব সময় উৎসাহী, কিন্তু বর্ধিত মূল্যের বাড়িতে গত তিন দশক ধরে যে ভাড়া পাওয়া যাবে, তা বিচার করতে নারাজ।
৫) বাড়িওয়ালা অন্যায় ভাবে ভাড়াটে উৎখাত করতে পারবেন না। কিন্তু যে-ভাড়াটে বহুতল বাড়িতে ফ্ল্যাট কিনে, আগের ঘরবাড়ি আটকে রেখে, অসহায় বাড়িওয়ালাকে শোষণ করেন, তাঁকে অতি দ্রুত উৎখাত করার সামাজিক ও নৈতিক দায় সরকারের। যে তথাকথিত বিত্তশালী বাড়িওয়ালার উপর পুরসভা বর্ধিত হারে কর চাপান, সেই বাড়িগুলোতে অস্বাভাবিক কম ভাড়ায় দীর্ঘকাল যাঁরা বাস করছেন, তাঁরা যাতে দ্রুত বাড়িভাড়া বাড়িয়ে ন্যায্য স্তরের ভাড়া দেন এবং তার জন্য বাড়িওয়ালাকে আদালতে বছরের পর বছর ঘুরে না বেড়াতে হয়, সেই দায়িত্বও সরকারেরই।
কোনও সরকার এ রাজ্যে অসহায় বাড়িওয়ালাদের কথা ভাবেননি। নিজেদের বাড়ি সংক্রান্ত ঝামেলা থাকলে দল ও বাহুবল দিয়ে সামলেছেন। নিজেদের বেলায় এ সব সমস্যা সমস্যা নয় বলেই সাম্যের নামে যা খুশি করার রাজনৈতিক অধিকারকেই ঠিক নীতি বলে ভেবেছেন। যে ভাড়াটে আজ বাড়িওয়ালা হয়েছেন, তাঁকে বাড়িভাড়া দিয়ে জীবনধারণ করতে হচ্ছে না। তাই তিনি তাঁর ‘ভাড়াটে’ সত্তাকে সযত্নে লালন করে যত দিন পারেন ভাড়ার ঘর আগলে রাখছেন। তাঁকে তাড়ায় কার সাধ্যি। গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বাস্তব সমস্যা। ফলে রাজনৈতিক ভাবে ঠিক পন্থা অবলম্বন শাসন ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য স্ট্র্যাটেজি। এতে অন্যায় বা ভণ্ডামির অবকাশ খানিকটা থাকবে, সেটাও অনস্বীকার্য। কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি অপরিহার্য।
আমরা ‘বাজার-বাজার’ বলে বাজারের দরদাম অনুযায়ী বাড়ির মূল্য নির্ধারণ করি, সেখানে কমিটি বসিয়ে, বিশেষজ্ঞ এনে গবেষণা করে, বাড়ির দাম বাড়িয়ে বর্ধিত হারে কর বসিয়ে দিলে সবাই ধন্যি-ধন্যি করবে। কিন্তু বর্ধিত মূল্যের বাড়িতে মধ্যযুগীয় ভাড়ার মূল্য নিয়ে কোনও কথা না বলে আদালতের দরজা দেখিয়ে দিলেই সরকারি দায়িত্ব পালন হয় না। অন্যায় হয়। যদি চলতি বাজার দর দিয়েই বাড়ির মূল্য ধার্য হয়, তা হলে সেখানে ভাড়ার মূল্য তেমন ভাবে ধার্য করে, যাতে আদালতে না গিয়েও সেই বর্ধিত মূল্য কার্যকর করা যায় তার ব্যবস্থা হয় না কেন?
বাড়ির সমস্ত কর দেওয়ার পর শংসাপত্র পাওয়া যায়। তাতে লেখা, পরে যদি কখনও নতুন হিসেব মতো পুরনো বছরের কর বাকি থাকে, আবার সেই বর্ধিত কর দিতে হবে। যদি তা হয়, সেটা সরকারি হিসেবের ভুল। তার দায় করদাতার উপর চাপবে কেন? এক বার কর শোধের শংসাপত্র পাওয়া গেলে আবার দশ বছর আগের ফাইল খুলবে কেন? অর্থাৎ, যত পারো বাড়ির মালিকদের শোষণ করো, যদি তাঁরা ‘অন্য’ ভাবে প্রতিপত্তিশালী না হন।
জবরদখলি জমি খালি না করলে, রাস্তাঘাট না হলে যথার্থ সরকারি পরিষেবা সৃষ্টি না হলে এক বৃহদংশ মানুষের অপকার হয়। যেমন অন্যায় হয় যাঁর নিজের জমি তাঁকে উন্নয়নের নামে উৎখাত করলে। জবরদখল প্রক্রিয়াকে ‘মানুষের’ কল্যাণকল্পে যাঁরা কাজে লাগাতে চান, তাঁরা নিজেদের বাড়ি-ঘরে জবরদখলকারীদের জায়গা দিতে চাইবেন তো? অর্থাৎ, অন্যায় ভাবে অন্যের জমি-জায়গা ঘর-বাড়ি দখল করে রাখলে সমাজের চোখে সেই প্রক্রিয়া অপরাধের শামিল। জোর গলায় বলার রাজনৈতিক শক্তি যদি কোনও গোষ্ঠীর না থাকে, তা হলেই সবাই তাঁদের শোষণ করবেন, এ কথা মেনে নেওয়া যায় না। রাজার শরীরে লজ্জা নিবারণের কিছু না থাকলেও কেউ তাকে সে কথা বলতে পারেনি। সেই শিশুটির অপেক্ষায় আছি।
|
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত। |