|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
কথা তো ছিল বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরির |
আর সে জন্য চাই পুষ্টি, চাই স্কুল, চাই শিক্ষক, চাই সদিচ্ছা আর তৎপরতা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষার খোঁজ নিয়েছেন
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত |
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে আরও এক বার স্পষ্ট হল যে, শিক্ষা অধিকার আইন সংবিধানসম্মত। তবে কি এ বার ৬-১৪ বয়সগুচ্ছের সব শিশু শিক্ষার সুযোগ পাবে দেশের প্রতি প্রান্তে? কোনও বাধাই থাকবে না? দারিদ্র? অপুষ্টি? বিদ্যালয়? বিদ্যালয় কাঠামো? আইন তো কতই, অঙ্গীকারও অন্তহীন। এখন সময় পাওনা বুঝে নেবার। এটা ন্যায্য দাবি। দাবি জানাব কার কাছে?
আমাদের সংবিধান বলছে, স্কুল শিক্ষার প্রাথমিক দায় রাজ্যের। শিক্ষা অধিকার আইন বাস্তবায়নে এই রাজ্য কতখানি প্রস্তুত? একটা কথা খুব স্পষ্ট যে, এই রাজ্য দেনার দায়ে ডুবে আছে। ঋণ ও তার সুদের কিস্তি, বেতন, কিছু সামাজিক দায় ও কিছু পরিষেবা, এই সব খাতে খরচ সামলাতেই সরকার কাহিল। অথচ এগোতে হবে। যে কোনও ক্ষেত্রে এগোতে হলে চাই উপযুক্ত কাঠামো, যা দীর্ঘকালের অবহেলায় এই রাজ্যে চরম রুগ্ণ দশায়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি পার হতে হলে চাই দূরদৃষ্টি, চাই দৃঢ় ও স্পষ্ট নীতি। মানুষ চাইছে সরকার শুভ কাজে এগোক। মানুষের মঙ্গলের জন্য সব কাজই শুভ কাজ, ঠিক করতে হবে কোনটা আগে, কোনটা পরে। প্রাধান্য ঠিক করাটা নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আর যে কোনও কাজে হাত দেবার আগে জানতে হবে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আর পা এগোবে কোন দিকে। রাজ্যের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বলতে চাই যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই দু’টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবার ক্ষেত্র। শিক্ষার হালচাল বুঝতে তাই কিছু তথ্য ঘাঁটা জরুরি। |
|
নাগরিক সমাজ ফিরেও তাকাবেন না? লেখাপড়া যে রকম। |
সর্বশিক্ষা অভিযানের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে আসা পঞ্চদশ জয়েন্ট রিভিউ মিশন (জে আর এম) ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে যে সমীক্ষা করে, তার রিপোর্ট আমাদের হাতে রয়েছে। তার কিছু অংশের দিকে আমরা তাকাব।
২০০৭-০৮ থেকে ২০০৯-১০ সময়ের মধ্যে এই রাজ্যে ৫৬৭৬টি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সম্মতি দিয়েছিল কেন্দ্র, স্থাপিত হয়েছে মাত্র ১৮৮৪টি। টাকাটা কেন্দ্রীয় সরকারের, তবু হয়নি। প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্য সময় চেয়েছিল, কেন্দ্র অব্যবহৃত অর্থ খরচের সময়সীমা বাড়াতে রাজি হয়নি। কেন রাজি হয়নি? সে-ও এক কৌশল। কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারও কিছু কম যায় না। কেন্দ্রের যুক্তি: এই রাজ্য শিক্ষা অধিকার আইন সম্পর্কিত বিধি আজও প্রকাশ করতে পারেনি, তাই তাকে কোনও বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না। ওই বিধি প্রকাশ করতে না পারাটা এই রাজ্যের এক অপরাধ নিশ্চয় এবং তা প্রমাণ করে যে, অতীতে শিক্ষা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিল যাঁরা, তাঁরা অগ্রাধিকারের তালিকা নির্বাচনে যথেষ্ট সুবিবেচনার পরিচয় দেননি। নতুন সরকার ইতিমধ্যেই শিক্ষা অধিকার আইন সম্পর্কিত বেশ কিছু ধারা রাজ্যে চালু করেছে, যা তার সদিচ্ছা স্পষ্ট করে দেয়। এ বার তো দেবে। তবুও না কেন্দ্র অনড়! কেন্দ্র যদি পদে পদে নিয়ম উঁচিয়ে রাজ্যগুলিকে তাড়া করতে থাকে, তবে যে তা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেই বিপন্ন করবে, এ কথাটা বলার সময় এসেছে।
২০০৬ সালে এই রাজ্যে স্কুলছুট শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লক্ষ, ২০১০ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২.৪ লক্ষে। হিসেবটা সর্বশিক্ষা অভিযানের সমীক্ষক দল বাড়ি-বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেছে। এই স্কুলছুটদের সামাজিক পরিচয় কী? দেখা গেছে তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি ও মুসলিম শিক্ষার্থীর যথাক্রমে ৭.৬%, ৫.২% ও ৬.৯% স্কুলছুট। সমস্যাটা বিপুল আকার ধারণ করেছে বিশেষত পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর আর মুর্শিদাবাদ জেলায়। উত্তর দিনাজপুর জেলায় ৬-১০ বয়সগুচ্ছের তফসিলি জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত শিশুদের প্রায় ২০% স্কুলছুট। সাক্ষরতার হারেও এই তিন জেলা পিছিয়ে আছে খুব যথাক্রমে ৬৫.৩৮%, ৬০.১৩% ও ৬৭.৫৩% (আর এক পিছিয়ে থাকা জেলা মালদহ, যেখানে সাক্ষরতার হার ৬২.৭১%)। এই তথ্য সামাজিক ন্যায় বিধানে, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের অবহেলা ও ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
স্কুলছুটের প্রকৃত সংখ্যা কত? এস আর আই-আই এম আর বি-র সমীক্ষকরা দাবি করেছেন যে, এই রাজ্যে ২০০৯ সালে স্কুলছুটের সংখ্যা প্রায় সাত লক্ষ। ফারাকটা অত্যধিক বেশি, আর তখনই মনে পড়ে যে, বিশেষজ্ঞরা বারে বারে এই রাজ্যের সরকারি তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। রাজ্যের সরকারি দফতরগুলি তথ্যসংগ্রহে সত্যনিষ্ঠ না হলে যে এগিয়ে চলার ছকটায় মস্ত ভুল থেকে যায়, এই কথাটি বোঝা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।
এ বার কিছু খারাপ খবরে দৃষ্টি দিই। জে আর এম রিপোর্ট বলছে, রাজ্যের প্রায় ৩০% প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘরের সংখ্যা দুই বা তার কম। তারা বলছে, রাজ্যের ১৩৪১টি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (এম এস কে) এবং সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় গৃহহীন। সর্বশিক্ষা অভিযানের অর্থ পেয়েও রাজ্য সরকার ৭৭৪০৩টি শ্রেণিকক্ষ, ১৬২৩২টি প্রধান শিক্ষকের কক্ষ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে, শৌচাগার নির্মাণেও ব্যর্থ। ৩৬৯০০টি শৌচাগার নির্মাণের অনুমোদন পেয়েও রাজ্য তার মাত্র ৫৬% শতাংশ গড়তে পেরেছে। জে আর এম আমাদের এই তথ্যও জানাচ্ছে যে, রাজ্যের প্রায় ৭৬% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ৩২% উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, আর যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, সেখানেও রয়েছে বিদ্যুতের বিল মেটানোর সমস্যা। মিশনের সদস্যরা যে-সব বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছেন, তার অধিকাংশতে তাঁরা দেখেছেন সূর্যালোকও প্রবেশের পথ পায় না। এই লজ্জা লুকোব কোথায়?
আর এক গভীর সমস্যা শিক্ষকের অভাব। প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক ও শিশুশিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে ২০১০-১১ সালে কর্মরত নিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা ২৬৬৬৯৬, কিন্তু শিক্ষা অধিকার আইন মোতাবেক চালাতে গেলে চাই ৪১৮২৪৭ জন নিয়মিত শিক্ষক। অর্থাৎ, ঘাটতি দেড় লক্ষের উপর। ঘাটতির কিছুটা পূরণ করা হয়েছে প্রায় ৯৬ হাজার অস্থায়ী শিক্ষক (প্যারা/চুক্তিনির্ভর/এস এস কে শিক্ষক) দিয়ে। অস্থায়ী শিক্ষকেরা তো কাজ ফুরোলেই ‘পাজি’। কিছু জেলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্যারা-টিচার নিয়োগ করে গেছে আগের সরকার। অস্থায়ী শিক্ষকদের বিপুল সমস্যা চেপেছে নতুন সরকারের ঘাড়ে। উচ্চ প্রাথমিক শাখায় শিক্ষক পদে ৫০% বিজ্ঞানের স্নাতক নিয়োগের বিধি থাকা সত্ত্বেও তা মানা হয়নি, যার ফলে এই রাজ্যে বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ভয়ংকর ভাবে সীমিত। |
ওরা প্রশ্ন করবে |
পরিব্যাপ্ত অন্ধকার নিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়। না বলতে পারলে ভাল হত, কিন্তু ওরা যে তাকিয়ে রয়েছে ওরা আগামী প্রজন্মের নাগরিক। নানা প্রকল্পের কথা, অর্থবরাদ্দের কথা অথবা আইন আর বিধির কথা তাদের শুনিয়ে লাভ কী? আজ হয়তো তারা কিছুই জানতে যায় না বা বুঝতে পারে না। কিন্তু তারা এক দিন প্রশ্ন করবে। তাদের প্রশ্নের জবাব দেবার দায় কেবল রাষ্ট্রের, এই কথা ভেবে ঘুমোতে পারে না নাগরিক সমাজ। তারও দায় আছে। এই রাজ্যের নাগরিক সমাজ কত শত বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তাদের আন্দোলন ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। এই নাগরিক সমাজ শিশুর শিক্ষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে না কেন? শিশু মানে আইন নির্ধারিত ছয় থেকে চোদ্দো বছরের শিশু কেবল নয়, যাদের বয়স ছয়ের কম, তাদের শিক্ষার আয়োজন নিয়ে কি কিছুই ভাববে না কেউ?
ছয় বছরের কমবয়সিদের কথাও একটু জানাতে ইচ্ছে হয়। শিক্ষা অধিকার আইনে ছয় বছরের কমবয়সিদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধিকার স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু তাদেরও তো নিশ্চয় শিক্ষার অধিকার আছে। কে তার দায় নেবে? এই রাজ্যে চরম অবহেলা সয়ে টিকে আছে আই সি ডি এস প্রকল্প। তারা কী পারে? শিক্ষা তো দূর, সেই প্রকল্প শিশুর পুষ্টির দিকেও যথেষ্ট নজর দিতে পারে না। সরকারি তথ্য বলছে যে, গত দশকে রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। এই সংবাদে কি তুষ্ট থাকা যায়? আমরা যে জানি, এ রাজ্যের শিশু ও মায়েদের অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার স্তর সভ্যতার কলঙ্ক। সেই কলঙ্ক চাপা দিয়ে পূর্বতন সরকার বছরের পর বছর আমাদের এগিয়ে চলার মনোহর কাহিনি শুনিয়েছে, আর বিশ্বাস করতে বলেছে সেই মায়েরা শিশুদের সুশিক্ষার আয়োজনে প্রবল উৎসাহে যোগ দেবে, সেই শিশুরা অধিকারের আনন্দে অপুষ্ট শরীরে দুলে দুলে পড়বে অ-এ অজগর!
নতুন সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সংস্কার হচ্ছে সিলেবাসের, সিলেবাসের বোঝা কমাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। কিছু পরিমাণ সাফল্য নিশ্চয় মিলবে অচিরে। কিন্তু অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ স্থগিত রেখে শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ণ সাফল্যলাভ অসম্ভব। আমরা প্রার্থনা করি, নতুন সরকার শিশু ও মায়েদের অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার সমস্যায় মোকাবিলায় তৎপর হবে। সেটাই হয়ে উঠুক স্বাস্থ্য পরিষেবার আশু ও প্রধান লক্ষ্য। যে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে শিশুর চোখেমুখে নেই অনাবিল আনন্দ, শরীরে নেই প্রাণচাঞ্চল্য, সেই শিক্ষাপ্রাঙ্গণ শিশুদের বাসযোগ্য নয়। বাসের অযোগ্য ভূমিতে কার কী অধিকার, তা নিয়ে মাথা ঘামানো বৃথা। |
|
|
|
|
|