ইংরাজি ভাষা মাঝেমধ্যে বড় দীন হইয়া পড়ে। যেমন, অপুষ্টিকে ইংরাজিতে ‘ম্যালনিউট্রিশন’ বলে, কুপুষ্টিকেও তাহাই। অথচ, দুইয়ের মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক। অপুষ্টি হয় খাদ্যের অভাবে, আর কুপুষ্টি হয় এক বিশেষ ধরনের খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকারক খাদ্য। চলতি ভাষায় তাহার নাম ‘জাঙ্ক ফুড’। এই খাদ্যে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন, প্রোটিন বা খনিজ থাকে না, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় দেহে ক্যালরি জমিতে থাকে। তাহার ফল মারাত্মক। যাহা সর্বাধিক উদ্বেগের, প্রধানত শিশুরাই এই ‘জাঙ্ক ফুড’-এর শিকার। এই ভ্রান্ত খাদ্যাভ্যাসে শিশুরা আজ এমন সব রোগের শিকার হইতেছে, অতীতে যাহা কল্পনাও করা যাইত না। দুইটি বিষয় লক্ষণীয় এক, জাঙ্ক ফুড খাওয়ার অভ্যাসটি কেবলমাত্র উচ্চ বর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরাও এই অ-খাদ্য কম-বেশি খায়; দুই, প্রবণতাটি শুধু শহরকেন্দ্রিক নহে। গ্রামের শিশুরাও জাঙ্ক ফুড-আসক্ত হইতেছে।
সমস্যাটি সত্যই জটিল। তাহার সমাধানও প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী কৃষ্ণা তিরথ তাঁহার মতো করিয়া একটি সমাধান ভাবিয়াছেন। তিনি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বলকে চিঠি লিখিয়া অনুরোধ করিয়াছেন, যেন শ্রীসিব্বল সকল বিদ্যালয়ের ক্যান্টিন এবং নিকটবর্তী দোকানগুলিতে জাঙ্ক ফুড বিক্রয় নিষিদ্ধ করিয়া দেন। এই প্রস্তাবটি যে মানসিকতা হইতে জন্মায়, তাহার নাম নিয়ন্ত্রণপ্রবণতা। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ চাপাইয়া দেওয়ার এই অভ্যাসটি ভারতের অভিজ্ঞান। নূতন আইন হয়, এবং সাধারণ মানুষ আরও একটি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া নিজেদের মতো চলিতে থাকেন। তবুও রাজনীতিকরা আইন বানাইবার খেলাটি ছাড়িতে পারেন না, কারণ তাহাই সহজতম পথ। যে কোনও সমস্যায় একটি নূতন আইন বাঁধিয়া দিলেই নেতাদের কাজ ফুরাইয়া যায় সমস্যাটির ইতর-বিশেষ হইল কি না, সেই খোঁজ রাখিবার দায় তাঁহাদের নহে। নেতারাও সম্ভবত জানেন, আইন বাঁধিয়া বিদ্যালয়ে জাঙ্ক ফুড বিক্রয় বন্ধ করিলেই সমস্যা মিটিবে না। কিন্তু, বিকল্প পথ সন্ধানের যে পরিশ্রম, তাঁহারা তাহা স্বীকার করিবেন কেন? আইন প্রণয়নের সহজ পথ তো আছেই!
আরও বহু সামাজিক সমস্যার ন্যায় শিশুদের জাঙ্ক ফুড-আসক্তির সমাধানও সমাজের মাধ্যমেই করা বিধেয়। এই জাতীয় খাদ্য কেন ক্ষতিকর, এবং কী ধরনের ক্ষতি হইতে পারে সে বিষয়ে অধিকাংশ অভিভাবকই যথেষ্ট অবহিত নহেন। শিশুরা তো নহেই। এই সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এই গণমাধ্যম-বিস্ফোরণের যুগে সরকার প্রচার চালাইতে পারে না, এমন কথা বিশ্বাসযোগ্য নহে। অভিভাবকরা বিপদের গুরুত্ব সম্যক বুঝিলে সন্তানের জেদ সামলাইবার ভিন্নতর পথ খুঁজিবেন। শিশুরাও যে নিজেদের ভুল বুঝিবে না, তাহা নহে। সচেতনতা বৃদ্ধিই এই বিপদকে ঠেকাইবার যথার্থ পথ। মুশকিল হইল, নেতারা আইন বাঁধিবার খেলা হইতে ফুরসত পান না যে এই সম্ভাবনাগুলিও খতাইয়া দেখিবেন। তাঁহাদের সচেতনতাও বাড়ুক। |