কূটনীতিতে কাহার ক্ষতিতে যে কখন কাহার লাভ! দক্ষিণ চিন সমুদ্রে গোল পাকিল, মাঝখান হইতে দিল্লির পোয়া বারো হইল। এই মুহূর্তে ভারত অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে, যেখানে এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দিকে চিন একই সঙ্গে দিল্লির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি মিত্রতার স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ বিষয়ে সুখস্বপ্ন দেখিতেছে, এবং তাহাকে নানা প্রলোভন-প্রকরণের মাধ্যমে ক্রমাগত ঘনিষ্ঠতর হইতে আহ্বান করিতেছে। সম্প্রতি বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণ বেজিং সফর করিয়া আসিলেন, এবং তাহার পর-পরই মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লিওন প্যানেটা দিল্লি ঘুরিয়া গেলেন। দুই সফরেই শোনা গেল, যথাক্রমে ভারত-চিন এবং ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিসাধনই নাকি আপাতত চিন ও আমেরিকার কর্তব্যতালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করে। এই পরিস্থিতি নূতন না হইলেও যে তীব্রতার সঙ্গে ভারতের প্রতি মিত্রতার প্রতিশ্রুতি লওয়া হইতেছে, তাহা কিছু নূতন বটে। এবং এই নূতনের কারণ আর কিছুই নহে, দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিনের ক্রমবর্ধমান খবরদারির সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টনক নড়িয়াছে এবং ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্যিক আদানপ্রদান তথা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষার প্রচেষ্টা বাড়িতেছে। দুই মহাশক্তি এই মুহূর্তে দক্ষিণ চিন সমুদ্রে প্রচ্ছন্ন পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, কে কত দ্রুত ক্ষমতাবলয় তৈরি করিতে পারে তাহার দৌড়। অবশ্যই এই দৌড়ে দুই পক্ষেরই ভারতকে দলে পাইলে সুবিধা। ক্ষমতার এই “নূতন ভারসাম্য নির্মাণের” পথে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দুই দৃষ্টিকোণ হইতেই।
ভারতকে প্রসন্ন রাখার চেষ্টার আরও কতগুলি কারণ রহিয়াছে। মার্কিন স্বার্থ অনুযায়ী, ইরানের সহিত সম্পর্ক-হ্রাসে ভারতকে রাজি করানোর কাজটি অত্যন্ত জরুরি। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে ভারতই ইরানের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক মিত্র, এবং সেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-সম্পর্কের পরিমাণ না কমিলে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ধার বহুলাংশে কমিয়া যায়। সুতরাং ভারতের উপর এই মুহূর্তে বিশেষ চাপ, বাণিজ্য অন্তত কিয়দংশে প্রত্যাহারের। মঙ্গলবারই মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের ঘোষণা ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশ ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য-হ্রাসের সিদ্ধান্ত লওয়ায় আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তালিকা হইতে এই সব দেশের নাম বাদ রাখা হইল। উল্লেখ্য, এই তালিকায় কিন্তু চিন নাই। মার্কিন পক্ষ হইতে একই প্রকার চাপ বেজিং-এর সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরির ক্ষেত্রটিতেও। আজ ওয়াশিংটনে যে কূটনৈতিক বৈঠকে দুই দেশের শীর্ষপ্রতিনিধিরা মিলিত হইবেন, সেখানেও এই চাপ প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন থাকিবে। তবে বেজিং-এর সহিত দিল্লির সম্পর্কের ক্ষেত্রে মার্কিন চাপে নত হইবার বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনও লক্ষণ নাই: বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক প্রত্যয়ের সঙ্গে ভারত “বহুমুখী কূটনীতি”র উচ্চারণে নিরত, অর্থাৎ বেজিং ও ওয়াশিংটন উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রক্ষায় উৎসাহী।
বাস্তবিক, এই বহুমুখী কূটনীতির প্রসঙ্গে যাহা লক্ষণীয়, দিল্লি যেন আপাতত এক নূতন আত্মপ্রত্যয় লাভ করিয়াছে। চিনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং যখন বলেন, ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একুশ শতকের প্রধানতম কূটনৈতিক অক্ষ হইয়া উঠিবার পথে, তখন ভারতের সাম্প্রতিক “অগ্নি-৫” উৎক্ষেপণের গুরুত্ব নেপথ্যে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। ৫০০০ কিলোমিটার অর্থাৎ বেজিং পর্যন্ত যে দেশের অস্ত্র-লক্ষ্য বিস্তৃত, তাহার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি কটাক্ষ বা ভর্ৎসনার পরিবর্তে যে বেজিং তাহার সহিত দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বের কথাই বলিতেছে, তাহা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। সাম্প্রতিক বেজিং-সফরে ভারতের বিদেশমন্ত্রী যতটা সাফল্য অর্জন করিলেন, তাহা চিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বলা চলে। সব মিলাইয়া বিশ্ব-রাজনীতির নানা আকস্মিক ও আবশ্যিক বাঁকের ফলে ভারত এখন ঈর্ষণীয় কূটনৈতিক গুরুত্বের অধিকারী। এই গুরুত্ব কোন পথে রক্ষা ও বর্ধন করা সম্ভব, যত্নসহকারে তাহার বিবেচনা প্রয়োজন। অলক্ষ্যে বিশ্ব আবারও দ্বিমেরু হইয়া উঠিবার দিকে। অলক্ষ্যে ভারতকেও সেই দুই মেরুর প্রধানতম সেতু হইবার দিকে অগ্রসর হইতে হইবে। |