রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে জল আরও ঘোলা হচ্ছে বামফ্রন্টের অন্দরে! ইউপিএ-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর নাম দেখে সমর্থনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বিষয়টি ‘ঝুলিয়ে’ রেখেছে ফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএম। অন্য দুই বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-ও একই মনোভাব পোষণ করছে। কিন্তু এই প্রশ্নে বাম রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের অবতারণা করেছে ফ্রন্ট শরিক সিপিআই। তাদের বক্তব্য, ‘ব্যক্তি’ নয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ‘নীতি’র প্রশ্নে। সেই নীতির প্রশ্নেই ইউপিএ-র মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করা উচিত বামেদের।
সনিয়া গাঁধী ইউপিএ শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করলে চার বাম দল ফের বৈঠকে বসবে। সেখানে সিপিআই তাদের এই অভিমত জানাবে। তবে সিপিআই নেতৃত্ব চাইছেন, তার আগেই নীতির প্রশ্ন বিবেচনা করে সিপিএম-সহ বাম নেতৃত্ব অবস্থান ঠিক করতে উদ্যোগী হোন। পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে সিপিআইয়ের প্রবীণ নেতা এ বি বর্ধন প্রথম ওই মতের কথা জানান। তাঁর সুরেই সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গুরুদাস দাশগুপ্তও বলছেন, “যে আর্থিক নীতির জন্য দেশের অবস্থা বেহাল, তার স্থপতি ইউপিএ। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি থমকে গিয়েছে। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই নীতির বিরুদ্ধেই তো বামপন্থীরা লড়াই করছি।” তাঁর যুক্তি, “এই পরিস্থিতিতে ইউপিএ-র মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন তো নয়ই, বামেদের উচিত সরাসরি বিরোধিতা করা!” সিপিআইয়ের এই মনোভাবেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বামেদের অবস্থান নির্ণয় আরও ‘জটিল’ হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চার বাম দলের মোট ভোট-মূল্য ৫১ হাজার ৬৮২ বা ৫%। যা এখনও একক ভাবে তৃণমূলের (৪%) চেয়ে বেশি।
বর্ধন-গুরুদাসদের মতে, প্রার্থীর নাম প্রণব মুখোপাধ্যায় হলে বামেদের এই বিরোধিতা আরও ‘প্রাসঙ্গিক’ হবে। কারণ, মনমোহন সিংহদের আর্থিক নীতি তিনিই হাতে-কলমে রূপায়ণ করছেন। সিপিআইয়ের বক্তব্য, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে বিজেপি-র ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে একযোগে বা একই দিনে তাদের সঙ্গে পৃথক ভাবে (যেমন ৩১ মে) বামেরা ধর্মঘটে যেতে পারলে সনিয়া-মনমোহনদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য কোনও প্রার্থীকে প্রয়োজনে বিজেপি-র সঙ্গে ভোট দিতেও বামেদের আপত্তি থাকা অনুচিত। গুরুদাসবাবুর বক্তব্য, “অনেকে বলছেন, প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হলে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে গৌরবজনক হবে। বাঙালি কেউ রাষ্ট্রপতি হলে বাঙালি হিসাবে আমিও খুশি হব। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাঙালি-আবেগ তো বিচার্য নয়।” প্রণববাবু ছাড়া অন্য কেউ ইউপিএ-র প্রার্থী হলে? গুরুদাসবাবুর জবাব, “সচিন তেন্ডুলকর হলেও কিছু যায় আসে না! আমাদের বলতে হবে নীতির কথা।” সিপিআই নেতৃত্বের মতে, প্রণববাবুকে ঘিরে বাঙালি-আবেগও খুব ‘যুক্তিযুক্ত’ নয়। কারণ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিরাট কোনও ‘অবদান’ রাখেননি। কংগ্রেসের জোট-শরিক তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ভাবে দিল্লিতে আর্থিক সাহায্যের জন্য দরবার করতে হচ্ছে, কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’র কথা বলতে হচ্ছে, তাতেই বিষয়টি স্পষ্ট।
সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য আরও অপেক্ষা করার পক্ষপাতী। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “কে প্রার্থী হবেন, না-জেনে কিছু ঠিক করা মুশকিল। একই সরকার থাকলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উপ রাষ্ট্রপতি সাধারণত রাষ্ট্রপতি পদে আসেন। এ ক্ষেত্রেও যে তা হবে না, কী ভাবে বলা যাবে?” একই ভাবে ফ ব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস বলছেন, “চার বাম দলের প্রাথমিক ভাবে আলোচনা হয়েছিল, সর্বসম্মত প্রার্থী হলেই সব চেয়ে ভাল। এখন দেখা যাক, ইউপিএ কার কথা বলে এবং তার ভিত্তিতে বিজেপি কী অবস্থান নেয়। সে সবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান ঠিক করতে হবে।” আরএসপি-র কেন্দ্রীয় নেতা অবনী রায়ের বক্তব্য, “সর্বসম্মত প্রার্থীর নাম এলে তখন কী হবে? সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে!”
সিপিআই অবশ্য পাল্টা বলছে, ইউপিএ-র প্রস্তাবিত নাম নিয়ে ‘সর্বসম্মতি’ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই অবান্তর। কারণ, সেখানেও সেই নীতির প্রশ্নই জড়িত। গুরুদাসবাবুর কথায়, “সর্বসম্মতি মানে মূলত ইউপিএ-র প্রার্থীকে বিজেপি-র মেনে নেওয়া! যদি বিজেপি ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থনও করে, তা হলেও আমাদের বিরোধিতা করার কথা ভাবতে হবে। তার প্রক্রিয়া ঠিক করতে হবে।” ঘটনাপ্রবাহ বলছে, রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সমর্থন আদায়ে কংগ্রেস যতটা উদ্বেগে, নিজেদের শিবিরে প্রকাশ কারাটের মাথাব্যথা তার চেয়ে কিছু কম নয়! |