ছেলে ও মেয়েদের এক সঙ্গে এক ঘরে বসিয়ে ক্লাস করানো চলবে না এই দাবিতে মঙ্গলবার রাজাবাজারের একটি স্কুলের সামনে শুরু হয় অভিভাবকদের বিক্ষোভ। তা গড়ায় রাস্তা অবরোধ পর্যন্ত। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানেও বিষয়টি পৌঁছয়। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ‘সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে’ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
স্কুলটির নাম মোমিন হাই স্কুল। পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন সকালে স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তার পরেই অভিভাবকেরা জানতে পারেন, ছেলে ও মেয়েদের এক সঙ্গে ক্লাস করতে হবে। তাতেই আপত্তি জানান তাঁরা। স্থানীয় কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নারকেলডাঙা মেন রোডে অবরোধ শুরু হয়। স্কুল সূত্রের খবর, এত দিন একাদশ শ্রেণিতে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ক্লাস হত। মোট ২৭৫ জনকে ভর্তি করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম থাকায় এ বার ছেলে ও মেয়েদের এক সঙ্গে ক্লাস করার কথা হয়। প্রকাশবাবুর বক্তব্য, “সোমবার এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিভাবকদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলাম। কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে অবরোধ করতে হল।” একই সঙ্গে ওই স্কুলে অবিলম্বে আরও শিক্ষক নিয়োগ ও আংশিক সময়ের শিক্ষকদের বকেয়া বেতনের দাবিও তোলেন বিক্ষোভকারীরা।
স্কুলটিতে শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকার জন্যই যে একাদশ শ্রেণিতে ছেলে ও মেয়েদের এক সঙ্গে ক্লাস করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তা স্বীকার করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। সরকারি সূত্রের খবর, বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে চলে আসায় শিক্ষকদের অভাব মেটানোর জন্য তৎপরতাও শুরু হয়েছে। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হল, এক ধরনের মানসিকতা। যার ফলে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে ও মেয়েদের এক ঘরে পাশাপাশি বসে ক্লাস করা নিয়ে ওঠে প্রতিবাদ, এমনকী হয় পথ অবরোধও।
এই মানসিকতাকে অবশ্য সমর্থন করছেন না ওসমান গনি, মিরাতুন নাহারের মতো শিক্ষাব্রতী থেকে শুরু করে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতো লেখক কেউই। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, আজকের দিনে খাস কলকাতা শহরে এই ধরনের মনোভাব শুধু প্রগতি-বিরোধীই নয়, রীতিমতো বিস্ময়কর।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ওসমানি গনির মনে পড়ে যাচ্ছে, গত শতকের পাঁচের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনার কথা। সে-বারও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ও ছেলেদের এক সঙ্গে ক্লাস করা নিয়ে সমাজের একাংশে আপত্তি উঠলে ছাত্রীরাই এর বিরোধিতা করেছিলেন। গনিসাহেবের প্রশ্ন: “আজকের কলকাতায় কোন যুক্তিতে ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে ক্লাস করা নিয়ে ওজর উঠছে? এ সবই মেয়েদের উন্নতির ক্ষেত্রে অহেতুক বাধা সৃষ্টি।”
সুচিত্রা ভট্টাচার্যর মতেও, “একুশ শতকের দুনিয়ায় এই ধরনের ‘রক্ষণশীলতা’ অকল্পনীয়।” প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক মিরাতুন নাহারও বলেছেন, “এমন একটা বিষয় নিয়ে প্রতিবাদের কোনও যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না।”
শিক্ষা-সংক্রান্ত মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী এক্রামুল বারি বলেন, “রাজ্যের বহু জেলায় গ্রামাঞ্চলে অনেক স্কুল আছে, যেখানে ছেলে-মেয়েরা এক সঙ্গে ক্লাস করে। যেমন, রায়নার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার গোলগ্রাম হাইস্কুল। আমি নিজে রায়নাতেই রামলাল আদর্শ বিদ্যালয়ে পড়েছি, সেখানেও ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়ত।”
গোলমালের খবর পেয়ে স্কুলশিক্ষা দফতরের তরফে কয়েক জন আধিকারিককে এ দিন রাজাবাজারের ওই স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। স্কুলশিক্ষা সচিব বিক্রম সেন বলেন, “স্কুল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেমতো তো কোনও স্কুলকে কো-এড স্কুল করা যাবে না। এর জন্য সরকারের অনুমতি লাগবে।” রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কথায়, “স্থানীয় মানুষ ও স্কুল কর্তৃপক্ষ কী চান, আলোচনা করে সেই মতো সিদ্ধান্ত হবে।” আজ, বুধবার স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনায় বসবেন স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তারা। |