প্রায় চারশো মৌজা চেয়ে মাত্র পাঁচটি পেয়ে ক্ষুব্ধ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা রাজ্যের উপরে ‘চাপ’ বাড়াল। ২ থেকে ৪ জুলাই পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সে টানা ৭২ ঘণ্টা বন্ধ পালনের হুমকি দিলেন মোর্চা নেতৃত্ব। কিন্তু একই সঙ্গে খোলা রাখলেন আলোচনার পথ। মোদ্দা কথায়, রবিবারও সুর খুব একটা চড়াল না শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্টে ‘হতাশ’ মোর্চা।
তবে কমিটির সুপারিশ মেনে নেওয়ার চুক্তি করেও এখন ভিন্ন সুর গেয়ে আন্দোলনের কথা ঘোষণা করায় মোর্চা নেতৃত্বের উপরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ এবং অসন্তুষ্ট বলেই সরকারি সূত্রের খবর। রাজ্য প্রশাসনের প্রশ্ন, শ্যামল সেন কমিটির দশ সদস্যের মধ্যে তো মোর্চারও চার জন ছিলেন। তা হলে এখন কেন ‘সুপারিশ মানব না’ বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে? পাহাড় ও সমতলের স্বাভাবিক জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া আন্দোলন বরদাস্ত করা হবে না বলে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে সরকার। কারণ, এর ফলে পাহাড়ের যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে ‘বিরূপ’ প্রভাব পড়বে। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী নিজে উন্নয়নের পরিপন্থী কোনও আন্দোলনের বিরুদ্ধে। ফলে, মোর্চার আন্দোলন কড়া হাতেই মোকাবিলা করা হবে বলে প্রশাসনিক সূত্রের ইঙ্গিত।
জঙ্গি আন্দোলন না করার ব্যাপারে পাহাড়েও চাপের মুখে রয়েছে মোর্চা। সেই কারণেই শনিবার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পরে বহু দিনের রীতি ভেঙে আচমকা কোনও আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেনি তারা। পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করতে রবিবার দুপুরে দার্জিলিঙের পাতলেবাসে দুপুর থেকে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য-সহ সমস্ত শাখা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। |
নরমে-গরমে |
• জুনের ভরা পর্যটন
মরসুমে বন্ধ বা অবরোধ নয়
|
• জিটিএ ভোট-
বিরোধিতার ভাবনা |
• ২৭ জুন চার পুরসভায়
চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরদের পদত্যাগ |
• মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে
চেয়ে আর্জির সিদ্ধান্ত |
• ২-৪ জুলাই দার্জিলিং,
তরাই ও ডুয়ার্সে বন্ধ |
• ১২ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী ও
জেলাশাসককে প্রতিবাদপত্র |
• শ্যামল সেন কমিটির
রিপোর্ট গ্রহণ না করার আবেদন |
• ১৭ জুলাই চার বিধায়কের
পদত্যাগ,
চুক্তির
প্রতিলিপি পোড়ানো |
•
২৭ জুলাই দার্জিলিঙে
গুরুঙ্গের জনসভা |
|
তবে জঙ্গি আন্দোলন না করার ব্যাপারে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ এবং দলের বড় একটা অংশের চাপ যেমন রয়েছে, তেমনি কট্টরপন্থী অংশের দাবিও মাথায় রাখতে হয়েছে মোর্চা নেতাদের। সেই ভারসাম্যের রাজনীতিরই পরিণতি এ দিনের আন্দোলনের ঘোষণা। যেখানে জুন মাসের ভরা পর্যটনের মরসুমকে ছাড় দিয়ে জুলাইয়ের গোড়ায় ৭২ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। সরকারের উপরে চাপ বাড়াতে পাহাড়ের চার বিধায়ক ও চারটি পুরসভার চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আর্জি জানানোর কথাও বলা হয়েছে।
এ দিন বৈঠক শেষে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “আমরা ৩৯৮টি মৌজা চেয়েছিলাম। সুপারিশ করা হয়েছে ৫টি’র। আমরা এতে অসম্মানিত, অপমানিত বোধ করছি। আমরা রিপোর্টের বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেব। মুখ্যমন্ত্রীর সময় চেয়ে দেখা করে ওঁকে সুপারিশ গ্রহণ না করার জন্য বলা হবে। আলোচনার রাস্তা খোলা রয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা আন্দোলন, বন্ধের রাস্তাতেও যাব।” মোর্চার এই শীর্ষ নেতার কথাতেই স্পষ্ট, তাঁরা ‘নরমে গরমে’ চলার কৌশল নিয়েছেন।
মোর্চা সূত্রের খবর, এ দিন বৈঠকের প্রথমেই তরাই ও ডুয়ার্সের নেতারা আন্দোলনে নামার কথা বলেন। কিন্তু, টানা আন্দোলনে ক্লান্ত পাহাড়বাসী ভরা পর্যটন মরসুমে নতুন আন্দোলন কতটা মেনে নিয়ে রাস্তায় নামবেন, তা নিয়ে দলের একটা বড় অংশ সংশয় প্রকাশ করে। এখনই আন্দোলনে নামা ঠিক হবে না বলে মত দেন তাঁরা। দলের প্রবীণ নেতারা বলেন, রাজ্যের উপর চাপ বজায় রাখা এবং কিছুটা সময় নিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখাটাই উচিত হবে। শেষে তরাই, ডুয়ার্সের নেতারাও সমস্ত সিদ্ধান্তের ভার বিমল গুরুঙ্গের উপরেই ছেড়ে দেন। তার পরেই সব দিক বাঁচিয়ে স্থির হয় আন্দোলনের রূপরেখা। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “জুনেই বন্ধ, অবরোধের রাস্তা হাঁটিনি। এতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার অনেকটা সময় রইল।”
কিন্তু জুলাইয়ে প্রস্তাবিত আন্দোলন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে মোর্চার একাংশের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। তাদের বক্তব্য, ওই সময় পাহাড়ে ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। জিটিএ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তার প্রস্তুতিও চলছে। ফলে সব মিলিয়ে সময়টা মোটেই আন্দোলনের অনুকূল নয়। তা ছাড়া, পাহাড়বাসীর একটা বড় অংশও মোর্চা নেতৃত্বের অবস্থান ভাল চোখে দেখছেন না। তাঁদের মনোভাবের কথা রাজ্য সরকারের কাছেও পৌঁছেছে। আর তার উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনে রাজ্য সরকার কড়া পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সর্বদল বৈঠক ডাকার দাবি তুলেছে কংগ্রেস ও সিপিএম। কিন্তু তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, জিটিএ চুক্তি হয়েছিল কেন্দ্র, রাজ্য এবং মোর্চার মধ্যে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনও সম্পর্ক নেই। তা হলে সর্বদল বৈঠকের প্রশ্ন কোথায়! |