চিকিৎসকদের পর হরিয়ানার ‘খাপ’-পঞ্চায়েতের মাতব্বররা। আমির খানের টেলিভিশন অনুষ্ঠান একের পর এক ভারতীয় সমাজের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানিতেছে। স্বার্থবাহকরা কেহ মামলা করার হুমকি দিতেছেন, তো কেহ বা অনুষ্ঠান বয়কট করার কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল হইতে অনুষ্ঠানটিকে বহিষ্কারের দাবি জানাইতেছেন। খাপ পঞ্চায়েতের মাতব্বরদের স্বার্থে স্পষ্টতই ঘা পড়িয়াছে। তথাকথিত ‘স্বগোত্র বিবাহ’ নিষিদ্ধ রাখায় তাঁহাদের বিধান। সেই বিধান অগ্রাহ্য করিলে রীতিমত আদালত বসাইয়া নবদম্পতিদের ‘বিচার করিয়া’ হত্যা করার বর্বরতা যে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশবাসীর চক্ষে তাঁহাদের ভয়ঙ্কর এক প্রতিক্রিয়াশীল এবং পৈশাচিক শক্তিরূপে শনাক্ত করিয়া সর্বজনীন ধিক্কারের সম্মুখীন করিতেছে, ইহা তাঁহারা বিলক্ষণ উপলব্ধি করিতেছেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তাঁহাদের বিষোদ্গারে এবং নিজেদের বর্বর সামাজিক বিধানের সপক্ষে ‘বৈজ্ঞানিক যুক্তি’ বিস্তারের প্রচেষ্টায় সেই উপলব্ধিজাত উদ্বেগটিই প্রকট।
একটি খাপ-পঞ্চায়েতের মাতব্বর যেমন বলিয়াছেন, যে কোনও সমাজের মেরুদণ্ডস্বরূপ যে-সকল প্রথা ও ঐতিহ্য গড়িয়া ওঠে, তাঁহারা সেগুলি রক্ষা করার জন্যই স্বগোত্র-বিবাহ নিষিদ্ধ করিয়াছেন। কিন্তু সমাজ তো কোনও শিলীভূত কুসংস্কারের বদ্ধ জলা নয়। পুরাতন কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াই কোনও সমাজ প্রাণবান ও অগ্রসর হইতে পারে। সমাজ-সংস্কারকরা সেই পরিবর্তনের, পুরাতন প্রথা বর্জন ও খারিজেরই প্রবক্তা। প্রাচীন ঐতিহ্য রদ করিয়া তাঁহারা নূতন, সপ্রাণ, বেগবান ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন। বঙ্গসমাজে যেমন কুলীন প্রথার পৈশাচিকতা দূর করিয়া বহুবিবাহের ঐতিহ্য লুপ্ত করা হয়। বাল্যবিবাহ ও সতীদাহের মতো বর্বর সামাজিক প্রথা রদ করিয়াই বঙ্গীয় সমাজ ঊনবিংশ শতকে অগ্রসর হইতে পারিয়াছিল। একবিংশ শতকে আসিয়াও হরিয়ানার খাপ-পঞ্চায়েতের মাতব্বররা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ঐতিহ্যের অপরিবর্তনীয়তার অজুহাত দিতেছেন। চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রগতি সত্ত্বেও হরিয়ানার জনবিন্যাসে কেন এখনও নারী-পুরুষের অনুপাত নারীর প্রতিকূলে বিপুল ভাবে সমাবেশিত, তাহা বুঝিতে অসুবিধা হয় না। বধূহত্যা, পণপ্রথাজনিত বধূনির্যাতনেও এই রাজ্যের স্থান উপরের দিকেই। কারণ সমাজের মাথারা এই সব কুপ্রথা ও ঐতিহ্যকে লজ্জাকর বলিয়া গণ্য করেন নাই। বরং এগুলিই তাঁহাদের মতে জাঠ সমাজের নিজস্বতার গৌরবময় অভিজ্ঞান।
কিছু মাতব্বর আবার স্বগোত্র-বিবাহকে অবৈজ্ঞানিক এবং সেই হেতু পরিত্যাজ্য বলিয়া ব্যাখ্যার চেষ্টা করিয়াছেন। কথায় বলে, দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। খাপ-পঞ্চায়েত ‘স্বগোত্র’ বলিতে একই পরিবারের সদস্যদের বুঝায় না, একই গ্রামের কিংবা পাশাপাশি গ্রামের বসবাসকারীদের বুঝায়। বাসিন্দাদের এই ভৌগোলিক সংলগ্নতার সহিত গোত্র বা কুল-এর কোনও সম্পর্কই নাই। এমনকী হিন্দু শাস্ত্রে, মনু-পরাশরে কিংবা সংহিতায় গোত্রের যে সংজ্ঞা রহিয়াছে, খাপ-পঞ্চায়েতের সংজ্ঞা তাহাও অনুসরণ করে না। ‘খাপ’-এর গোত্রবিষয়ক ধারণাটি সম্পূর্ণ মনগড়া, অবৈজ্ঞানিক ও প্রতিক্রিয়াশীল। অথচ এই ধারণার ভিত্তিতেই এ ধরনের বিবাহের ফসলস্বরূপ বংশধরদের মধ্যে জিন-ঘটিত রোগের প্রাদুর্ভাবের ভুয়া শঙ্কাকে একটি ‘বিজ্ঞানসম্মত’ বিধান বলিয়া প্রচার করিতেছেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বন্ধ করার দাবির পিছনে এক দিকে যেমন রহিয়াছে সমাজের অনড় অচলায়তনটি অক্ষত রাখার কায়েমি তাগিদ, অন্য দিকে তেমনই আছে ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা গায়ের জোরে খর্ব করার তাগিদও। শেষোক্ত তাগিদটি রাজ্যে রাজ্যে ইদানীং সংক্রামক ব্যাধির দ্রুততায় ছড়াইতেছে। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নহে। |